শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এ পি জে আব্দুল কালামকে প্রার্থী করানোর চেষ্টা করেও তাঁকে রাজি করাতে পারলেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিজেপি-র কিছু শীর্ষ নেতা।
আজ দুপুরে কালাম লিখিত বিবৃতি জারি করে জানিয়ে দিলেন, তিনি কখনওই আরও এক বার রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হতে চাননি। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্য রাজনৈতিক দল তাঁকে প্রার্থী করতে চেয়েছিলেন। অনেক নাগরিকও সেই ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। সকলের ইচ্ছায় তিনি আপ্লুত। তবে সামগ্রিক বিষয় ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তিনি না লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
কালাম এ ভাবে বিবৃতি দিয়ে সরে দাঁড়ানোয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘিরে জাতীয় রাজনীতিতে নতুন মোড় এল। কালামের সিদ্ধান্তে কিছুটা হলেও মমতাকে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হল। একই সঙ্গে বিজেপি-ও কিছুটা বিপাকে পড়ল। যদি
রাষ্ট্রপতি পদে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বিরোধিতা করতে হয় তা হলে পূর্ণ সাংমাকে সমর্থন করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোনও পথ খেলা রইল না। বস্তুত, আজ রাতে বিজেপি-র কোর কমিটির বৈঠকে সাংমাকে সমর্থন করার সিদ্ধান্তই হয়েছে। আগামিকাল এনডিএ-র বৈঠকে যাতে সিলমোহর পড়ার সম্ভাবনা। মমতা অবশ্য এখনও এ ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নেননি।
অথচ ঘটনা হল, আজ সকালেই প্রার্থী হতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন কালাম। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত বদলান। এই নাটকীয় পট পরিবর্তন হল কেন?
রাজধানীর রাজনীতির কারবারিদের অনেকের মতে, মমতার সঙ্গে মিলে কালামের নাম যিনি প্রস্তাব করেছিলেন, সেই মুলায়ম সিংহ যাদবই তাঁকে বিরত করার কাজে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছেন। |
|
রবিবার রাত |
সোমবার
সকাল |
• জয়ললিতাকে মমতার ফোন। সাংমাকে সমর্থন না করার
অনুরোধ।
জানান, কালামকে তিনি রাজি করাচ্ছেন।
• কালামকে সমর্থনের কথা বলে জয়াকে মোদীর ফোন। কালামের
বিরোধিতা
নীতীশ, শিবসেনার পক্ষেও করা মুশকিল, ধারণা বিজেপির। |
• কালামকে ফোন করে রাজি করানোর চেষ্টা আডবাণীর।
• মায়ার বাড়িতে গেলেন সুব্রহ্মণ্যম স্বামী
• দুপুরের মধ্যে সুধীন্দ্র কুলকার্নি দু’বার দেখা
করলেন কালামের সঙ্গে। |
দুপুর দেড়টা |
পৌনে তিনটে |
• সর্বসম্মত প্রার্থীর পক্ষে
সওয়াল নীতীশের। |
• কংগ্রেসের অনুরোধে কালামকে মুলায়মের বার্তা,
ভোটে লড়লে হার নিশ্চিত।
• মুলায়ম জানালেন, প্রণবকেই সমর্থন।
কালামের অধ্যায় শেষ। |
সোয়া তিনটে |
সাড়ে চারটে |
• কালাম জানালেন, তিনি দৌড়ে নেই। তাঁর উপর আস্থা
রাখার
জন্য মমতার
প্রতি কৃতজ্ঞতা।
• জয়ললিতার ফোন মমতাকে। সাংমাকে সমর্থন করার অনুরোধ। |
• কালামের সিদ্ধান্তকে স্বাগত কংগ্রেস মুখপাত্র মণীশ
তিওয়ারির। আশা, মমতা সমর্থন করবেন প্রণবকে। |
ছ’টা |
রাত ন’টা |
• মেনকা গাঁধী প্রণববাবুর সঙ্গে দেখা করে বললেন, “উনি যোগ্য ব্যক্তি।” |
বিজেপির কোর গ্রুপের বৈঠক।
|
রাত সাড়ে দশটা |
সাংমার বাড়িতে গেলেন সুব্রহ্মণ্যম স্বামী |
|
এ ব্যাপারে কংগ্রেস মুলায়মকে চাপ দিচ্ছিল। তারা আলাদা ভাবেও কথা বলছিল প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে। কালামকে নিরস্ত করার দায় মুলায়মের নিজেরও ছিল। কারণ, তিনিই কালামের নাম বলেছিলেন। তাঁর সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। কালাম শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হলে মুলায়মকে বিব্রত হতে হত। কালামকে সমর্থনের প্রশ্নে সমাজবাদী পার্টিতে বিভাজনও দেখা দিতে পারত।
সেই কারণেই মুলায়ম কালামকে বোঝান, এখন যাঁরা আপনাকে প্রার্থী হতে অনুরোধ করছেন, তাঁদের হাতে সংখ্যা নেই। সেই যুক্তি মেনে নেন কালাম। তার পর আজ দুপুরেই মুলায়ম জানিয়ে দেন, কালাম-পর্ব শেষ। কালামের নিজের বিবৃতি তখনও আসেনি।
কিন্তু বিজেপি-ও তো সমান তালে চেষ্টা চালাচ্ছিল কালামকে রাজি করানোর। এবং তাঁর সমর্থনে কংগ্রেস-বিরোধী দলগুলির মধ্যে একটা ঐক্য গড়ে তোলার। নরেন্দ্র মোদী নিজে সাংমার নামের প্রস্তাবক জয়ললিতাকে ফোন করে বলেছিলেন, কালাম প্রসঙ্গে মমতা ঠিকই বলেছেন। আনন্দবাজারকেও তিনি বলেছিলেন, “এটা তো শুধু রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নয়। ২০১৪ সালের ভোটের একটা মহড়াও হচ্ছে।”
তা হলে বিজেপি ব্যর্থ হল কেন? দলের একাংশের মতে, কালামের সঙ্গে আলোচনার প্রক্রিয়াটাই ঠিক হয়নি। এ ব্যাপারে অরুণ জেটলিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। কিন্তু জেটলি এত দিন দেশের বাইরে ছিলেন। ফিরে দেখেন পরিস্থিতি অনেকটাই নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে।
জেটলি বিদেশে থাকায় আডবাণীর অনুমতি নিয়ে কালামের সঙ্গে দেখা করতে যান এনডিএ-র নতুন শরিক জনতা পার্টির নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী ও গুরুমূর্তি। এই দু’জনের ভূমিকা নিয়ে বিজেপিতে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। নিতিন গডকড়ী থেকে অরুণ জেটলিরা মনে করছেন, কালামের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট হয়ে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত গত কাল রাতে সুধীন্দ্র কুলকার্নির সঙ্গে বৈঠক করেন জেটলি। আজ কুলকার্নি দু’-দু’বার কালামের সঙ্গে দেখা করেন। কালাম রাজি হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েও শেষ পর্যন্ত মুলায়মের যুক্তি মেনে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন।
বিজেপি-র যে সব নেতা কালামের হয়ে মুখ খুলেছিলেন, তাঁদের চেষ্টা কতটা ঐকান্তিক ছিল তা নিয়েও দলে প্রশ্ন রয়েছে। অনেকে যেমন বলছেন, মোদী কালামের হয়ে সমর্থন জোগাড়ের চেষ্টা করছিলেন, কারণ তাঁর প্রবল প্রতিপক্ষ নীতীশ কুমার প্রণবকে সমর্থন করছেন। এটা আসলে তাঁর ব্যক্তিগত রাজনীতি। পাশাপাশি এ-ও বলা হচ্ছে যে, শেষ মুহূর্তে জেটলির চেষ্টায় হয়তো ত্রুটি ছিল না, কিন্তু তিনি নিজেও প্রণবের প্রতি কিছুটা দুর্বল। কেন্দ্রে বাণিজ্যমন্ত্রী থাকার সময় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিভিন্ন খুঁটিনাটি প্রণবের কাছ থেকেই বুঝেছিলেন জেটলি। সেই সময় থেকে দু’জনের সম্পর্ক মধুর।
কালাম সরে দাঁড়ানোয় এখন যা পরিস্থিতি তৈরি হল, তাতে মমতার সামনে দু’টি পথ খোলা রইল। এক, ভোটদানে বিরত থাকা। দুই, সাংমাকে সমর্থন জানানো। কংগ্রেস চাইছে প্রণববাবুকে সমর্থন না করলে মমতা বরং ভোটদানে বিরতই থাকুন। তা হলে ইউপিএ অটুট থাকবে। অন্য দিকে বিজেপি সাংমার পক্ষে মমতার সমর্থন চাইছে। তা হলে কংগ্রেস শিবিরকে দুর্বল করার কৌশল সফল হয়। কিন্তু রাজ্যে মুসলিম ভোটের জন্য মমতার পক্ষে সরাসরি বিজেপি-র সঙ্গে যাওয়া কঠিন। আবার সিপিএমের সঙ্গে যাওয়াও তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে তাঁর হাতে বিকল্প খুব সীমিত।
|