দেশের অর্থনীতির আকাশে আরও গাঢ় হচ্ছে আশঙ্কার মেঘ। বাড়ছে ভারতে টাকা ঢালার ঝুঁকি। মার্কিন মূল্যায়ন সংস্থা এসঅ্যান্ডপি-র পর এই পূর্বাভাস এ বার ফিচ-এরও। সোমবার আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন সংস্থাটির এই ঘোষণা যেমন নয়াদিল্লির রক্তচাপ আরও বাড়িয়েছে, তেমনই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সিদ্ধান্ত একেবারে জল ঢেলে দিয়েছে শিল্পমহলের আশায়। প্রায় সকলেরই আশা ছিল, বৃদ্ধির চাকায় গতি আনতে এ দিন অন্তত সুদ কমানোর রাস্তায় হাঁটবে শীষর্র্ ব্যাঙ্ক। কিন্তু সে আশা মেটেনি। বরং চড়া মূল্যবৃদ্ধিতে রাশ টানতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অনড় থেকেছে সুদ অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্তে। যার জেরে প্রায় ২৪৪ পয়েন্ট পড়েছে সেনসেক্স। ডলারে টাকার দাম পড়েছে ৫৩ পয়সা।
তবে ঘরে-বাইরে এই টালমাটাল দশার মধ্যে অন্তত কিছুটা আশার আলো দেখিয়েছে গ্রিস। এ দিনই বেরোনো সেখানকার ভোটের ফলে স্পষ্ট যে, শেষ পর্যন্ত ইউরোজোন ছেড়ে বেরিয়ে না-যাওয়ার পক্ষেই রায় দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। ফলে, আপাতত হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে ইউরোপ-সহ সারা দুনিয়া।
গ্রিস নিয়ে ভারতের স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে ফিচ-এর পূর্বাভাস। তারা জানিয়েছে, ভারতের অর্থনীতি এখন যেখানে দাঁড়িয়ে, তাতে আগামী দিনে তার আরও বিবর্ণ ছবি ফুটে ওঠার সম্ভাবনা। সেই কারণে এ দিন তার সম্পর্কে নিজেদের পূর্বাভাস ‘স্থিতিশীল’ (স্টেব্ল) থেকে ‘নেতিবাচক’ (নেগেটিভ)-এ বদলে দিয়েছে ফিচ। একই সঙ্গে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, পরিস্থিতি না-বদলালে কমবে দেশের ক্রেডিট রেটিং-ও। উল্লেখ্য, গত ২৫ এপ্রিল ঠিক এই ভাবেই ভারত সম্পর্কে নিজেদের পূর্বাভাস বদলেছিল এসঅ্যান্ডপি। ‘ব্রিক’ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির মধ্যে ভারতই প্রথম রেটিং খোয়ানোর গাড্ডায় পড়তে পারে বলে ১১ জুন হুঁশিয়ারিও দিয়েছিল তারা। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, অর্থনীতির এই বেহাল দশার অন্যতম কারণ হিসেবে দুর্নীতির কথা উল্লেখ করেছে ফিচ। আর বাকি তিন কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বৃদ্ধির ঢিমে গতি, চড়া মূল্যবৃদ্ধি এবং থমকে যাওয়া আর্থিক সংস্কারকে।
ফিচ-এর এই পর্যবেক্ষণ অবশ্য মানতে চাননি অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাঁর দাবি, “সংস্কারের রাস্তায় ঘুরে দাঁড়ানোর যে চেষ্টা ভারত করছে, তার প্রতিফলন নেই পূর্বাভাসে। তা ছাড়া যে তথ্যের ভিত্তিতে এই রিপোর্ট, তা-ও কিছুটা পুরনো।” আবার অর্থমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা কৌশিক বসুর মতে, সাধারণত কোনও বিষয়ে প্রায় একই রকম অবস্থান নেয় মূল্যায়ন সংস্থাগুলি। ফিচ-এর এই পূর্বাভাসও সেই মানসিকতার ব্যতিক্রম নয়। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে শিল্পমহলের একটি অংশও মনে করছে, ফিচের রেটিং ভারতীয় অর্থনীতির মানদণ্ড হতে পারে না। তা-ছাড়া, বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতিতে ৬.৫% বৃদ্ধির হার থাকা সত্ত্বেও এমন গেল-গেল রব কতটা যুক্তিসঙ্গত, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে তারা।
কিন্তু এ সব সত্ত্বেও ভারত সম্পর্কে বিশ্বের প্রধান তিন মূল্যায়ন সংস্থার একই রকম মত ভারতের ভাবমূর্তি মলিন করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকেই। এসঅ্যান্ডপি আগেই জানিয়েছে যে, ভারতীয় অর্থনীতিকে খাদের ধারে দাঁড় করিয়েছে শিকেয় ওঠা সংস্কার আর কেন্দ্রের নীতিপঙ্গুত্ব। আর এক মার্কিন মূল্যায়ন সংস্থা মুডিজ-এর শাখা মুডিজ অ্যানালিটিকস্ মনে করে, ভারতে বৃদ্ধির হারকে শ্লথ করে দিচ্ছে নিষ্ফলা রাজনীতি আর সিদ্ধান্ত গ্রহণে কেন্দ্রের দ্বিধাগ্রস্ততা। এমনকী এই ব্যর্থতার জন্য প্রধানমন্ত্রী এবং সনিয়া গাঁধীর দিকে আঙুল তোলে এই দুই সংস্থা। এই পরিস্থিতিতে তৃতীয় সংস্থার কাছে পাশ নম্বরটুকু তুলতে মরিয়া ছিল অর্থ মন্ত্রক। কিন্তু সেই আশাতেও জল ঢেলে দিয়েছে ফিচ।
ফিচের বিশ্লেষণ, ভারতে বৃদ্ধির গতি শ্লথ। অথচ পিছু ছাড়ছে না চড়া মূল্যবৃদ্ধি। এক দিকে, ঘাটতির বহর ঊর্ধ্বমুখী। উল্টো দিকে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জাতীয় আয়ের সাপেক্ষে ঋণের অনুপাত। ‘বিবিবি’ রেটিংভুক্ত অধিকাংশ দেশের ঋণ যেখানে জাতীয় আয়ের ৩৯ শতাংশের আশেপাশে, ‘বিবিবি(-)’ রেটিং সমৃদ্ধ ভারতের ক্ষেত্রে তা ৬৬%। তারা মনে করছে, সংস্কারের ধারা অব্যাহত রেখে বিদেশি বিনিয়োগ টানতে পারলে এই ফাঁস আলগা করা সহজ হত। কিন্তু তাতে বাধা হচ্ছে নীতিপঙ্গুত্ব, দুর্নীতি। সেই কারণেই আপাতত এ দেশের রেটিংয়ে হাত না-দিলেও, আগামী দিনে তা কমতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে তারা। একই সঙ্গে জানিয়েছে, বিশ্ব জুড়ে অর্থনীতির টালমাটালের ছাপ পড়েছে ‘ব্রিক’ গোষ্ঠীর বাকি দেশ ব্রাজিল, চিন এবং রাশিয়ার উপরেও।
কোনও দেশকে ঋণ দেওয়া কতটা ঝুঁকির, তারই মূল্যায়ন ক্রেডিট রেটিং। রেটিং যত ভাল, তাকে ঋণ দেওয়া তত কম ঝুঁকির। আর তা কমার মানে ঋণের অর্থ ফেরত না-পাওয়ার ঝুঁকি বাড়া। তাই এ ক্ষেত্রে ঝুঁকি বাড়লে ঋণের জন্য আরও চড়া সুদ গুনতে হবে ভারতকে। এমনিতেই ঘাটতির বোঝায় নুয়ে থাকা ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে যা সুখবর নয়। তা ছাড়া, এক বার লগ্নিযোগ্যতার তকমা খোয়ালে, এ দেশের সরকারি বন্ডে টাকা ঢালতে দু’বার ভাববেন বিদেশি লগ্নিকারীরা। ধাক্কা খাবে ভারতের ভাবমূর্তি। আগামী দিনে তা ভাল বিজ্ঞাপন হবে না শিল্পে বিদেশি বিনিয়োগ টানার ক্ষেত্রেও। |