এক মন্দার ধাক্কা এখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি গোটা দুনিয়া। তার মধ্যেই ইউরো জোনের অর্থ সঙ্কটের বাতাবরণে দিগন্তে রক্তচক্ষু দেখাতে শুরু করেছে আর এক ‘মহামন্দা’। এবং সেই ‘মহামন্দা’র ধাক্কা পুরোদস্তুর আছড়ে পড়ার আগেই তাকে প্রতিহত করতে ইউরোপের দেশগুলির ওপর আজ প্রবল চাপ সৃষ্টি করতে নেমে পড়ল ভারত-সহ জি-২০-র বাকি সদস্য দেশগুলি। কেন না নয়াদিল্লির উদ্বেগ, ইউরোপে সেই আগুন ছড়িয়ে পড়লে লহমা মাত্র সময় লাগবে না ভারতে পৌঁছতে। তার থেকেও বড় বিষয়, চার বছর আগে মন্দার গ্রাস থেকে যে ভাবে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল ভারত, এ বার সেই আর্থিক শক্তিও অনুপস্থিত। সুতরাং দ্রুত সামাল দিতে না পারলে ঘরোয়া কারণে এমনিতেই বেহাল অর্থনীতির সঙ্কট যে আরও তীব্র হয়ে উঠবে, সেই দেওয়াল লিখন এখন থেকেই স্পষ্ট।
ভারতীয় সময় গত কাল প্রায় মধ্যরাতে মেক্সিকোর মাটি ছুঁয়েছে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের বিমান। এবং বিমান থেকে নামার পরেই চমক। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে স্বাগত জানিয়ে হিন্দিতে লেখা হোর্ডিং, ‘আপকা স্বাগত হ্যায়’! কিন্তু সেই চমক নিয়ে ভাবার সময় কোথায়? আর্থিক সঙ্কট নিয়ে উদ্বেগ যে পিছু ছাড়ছে না! তার মধ্যেই আজ আরও একটি মূল্যায়ন সংস্থা ‘ফিচ’ ভারতের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। দিন সাতেক আগেই মার্কিন মূল্যায়ন সংস্থা এসএন্ডপি এ ব্যাপারে তাদের উদ্বেগ জানিয়েছিল। ভারতের বক্তব্য, বিশ্বের আর্থিক সঙ্কটের কারণেই সমস্যা বেড়েছে। ফলে সে দিকেও নজর রাখতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যে যথেষ্টই উদ্বেগজনক, তার প্রমাণও মিলল প্রধানমন্ত্রী লস কাবোস পৌঁছনোর পরে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী বললেন, “গভীর সঙ্কটে রয়েছে গোটা বিশ্ব। আমি আশা করব, জি-২০ এমন কিছু গঠনমূলক পদক্ষেপ করবে, যার ফলে এই সঙ্কট দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারবে বিশ্ব অর্থনীতি।” আর জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে আসা যোজনা কমিশনের উপাধ্যক্ষ মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ার কথায়, “মূল সমস্যার কেন্দ্র ইউরো জোন। ইউরোপের দেশগুলি যদি এখনই বলিষ্ঠ পদক্ষেপ না করে, তা হলে দ্বিতীয় মন্দা অনিবার্য।” তাঁর ব্যাখ্যা, ২০০৮ সালে প্রথম মন্দার প্রকোপ যখন সংক্রমণের মতো গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, তখন শুরু থেকেই ইতিবাচক পদক্ষেপ করেছিল জি-২০ভুক্ত দেশগুলি। কিন্তু এ বার সেই লক্ষণ এখনও দেখা যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে মন্টেক এ-ও স্বীকার করে নেন, “চার বছর আগে যে শক্তি দিয়ে মন্দা ঠেকাতে পেরেছিল ভারত, এখন ততটা অস্ত্র আর নেই নয়াদিল্লির অস্ত্রাগারে। তেমন আর্থিক ব্যবস্থা্ নেওয়ার সুযোগও কম।”
প্রশান্ত মহাসাগরে ভূখণ্ডের শেষ প্রান্ত আল আর্কো এই লস কাবোসেরই অংশ। ইউনেস্কো এটিকে বিশ্বের অন্যতম ‘হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সমুদ্রের কোল ঘেঁষা বাকি লস কাবোসের এক দিকে রুক্ষ সব পাহাড়, সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির ক্যাকটাসের বাস। সমতলে সমুদ্রের দিকে গড়ে উঠেছে সব বিলাসবহুল রিসর্ট, সৈকতাবাস। পর্যটকরা তিমি মাছ দেখে আর গল্ফ খেলে সময় কাটান। অথচ জি-২০ সম্মেলনের ধাক্কায় এ হেন লস কাবোস যেন তার ফুরফুরে মেজাজকে ইতিমধ্যেই বিসর্জন দিয়ে বসেছে প্রশান্ত মহাসাগরে। শহরের দখল নিয়েছে অনিশ্চয়তা আর আশঙ্কা! তবু এখনও পর্যন্ত জি-২০-র কাছে ইতিবাচক খবর হল, গ্রিসের নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় বসতে চলেছে নিউ ডেমোক্র্যাসি দল। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বামপন্থীদের সঙ্গে তাদের ব্যবধান যদিও সামান্যই, তবু তাদের জয়কে ইতিবাচক বলেই দেখছে গোটা ইউরোপ। এবং অন্য দেশগুলিও। ফল প্রকাশের পরে সম্ভাব্য শাসক গোষ্ঠী জানিয়ে দিয়েছে, আথেন্স অভিন্ন ইউরো মুদ্রার জোট থেকে বেরোবে না।
যদিও মন্টেকের কথায়, “এটা প্রারম্ভিক প্রতিক্রিয়া মাত্র। কিন্তু গ্রিস যাতে এই অবস্থানে টিকে থাকে, সে জন্য ইউরোপের আর্থিক ভাবে শক্তিশালী দেশগুলিকে চাপ বজায় রাখতে হবে। কেন না এই মুহূর্তে যত না সঙ্কট, তার থেকেও বেশি বাজারের আতঙ্ক।” তাঁর ব্যাখ্যা, “গ্রিস ইউরো জোন থেকে বেরিয়ে গেলে আতঙ্ক বাড়বে। তার ধাক্কায় বিনিয়োগকারী আরও টাকা তুলে নেবে সেখানকার ব্যাঙ্কগুলি থেকে। মুখ থুবড়ে পড়বে ইউরোপের সব ব্যাঙ্ক। তাতে বিপুল ধাক্কা খাবে বিশ্ব অর্থনীতি। কিন্তু ইউরোপের দেশগুলি রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখালে, সেই বিপদ এড়ানো সম্ভব।”
সাউথ ব্লকের এক কূটনীতিকের কথায়, “আসলে ইউরো জোনের মূল সমস্যাটাই রাজনৈতিক। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ মিলে একটি ইউনিয়ন তৈরি হয়েছে। তৈরি হয়েছে একটি অভিন্ন মুদ্রা। অথচ প্রতিটি দেশের আর্থিক নীতি, সরকার ও তার রাজনৈতিক লক্ষ্য ভিন্ন! তাই প্রাকৃতিক নিয়মেই দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। এই অবস্থায় সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চলেছে জার্মানির ভূমিকা। ইউরোপের সব থেকে শক্তিশালী অর্থনীতি এই দেশের। কিন্তু জার্মানি তার ব্যয়সঙ্কোচের নীতি ছেড়ে বৃদ্ধির সহায়ক পথে হাঁটবে কিনা, সেটাই প্রশ্ন।” জার্মানির ওপর চাপ বাড়াতে ইতিমধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জার্মান চ্যান্সেলার আঙ্গেলা মকের্র্লের সঙ্গে কথা বলেছেন। আজ জি-২০ সম্মেলন চলাকালীন মর্কেলের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসবেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ-ও। ইউরো সঙ্কট কাটাতে মনমোহনও জার্মানির ওপর চাপ দেবেন কি? মন্টেক অবশ্য এই প্রশ্নের জবাব কৌশলে এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। তবে সাউথ ব্লক সূত্রে বলা হচ্ছে, সেই সম্ভাবনা ষোল আনা।
তবে এর পরেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। মন্দা ঠেকাতে ইউরোপ কোনও ইতিবাচক ও বলিষ্ঠ ব্যবস্থা না নিলে ভারত কী ভাবে প্রভাবিত হবে? বিশেষ করে সে নিজেও যখন বেশ চাপে রয়েছে। মন্টেকের জবাব, “দ্বিতীয় মন্দা মহামারীর মতো ছড়ালে ভারতও এড়াতে পারবে না। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলির ওপর প্রভাব পড়বেই। তবে আমাদের সৌভাগ্য যে এখনও এমার্জেন্সি বোতাম টেপার মতো পরিস্থিতি হয়নি।” কিন্তু ইউরোপ যদি ভারতের হাল দেখে আর ভরসা না করে এ দেশ থেকে তার লগ্নি তুলে নেয়? মন্টেকের ব্যাখ্যা, সেই টাকা তুললেও তা লগ্নি করবে কোথায়? কারণ সব দেশেই মন্দার ছোঁয়া লেগেছে। তবু এরই মধ্যে ভারত এবং চিনের অবস্থা কিছুটা মন্দের ভাল। তিনি বলেন, “ঘরোয়া কারণে বৃদ্ধির হার কিছুটা কমেছে ঠিকই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছেন। পরিকাঠামো প্রকল্পগুলির জট ছাড়াতে বৈঠকও করেছেন। আশা করা হচ্ছে, ছ’মাস পর থেকে সেই সব সুফল আসতে শুরু করবে।” বর্তমানের মন্দা পরিস্থিতিতে বৃদ্ধির হার সাত-এর কাছাকাছি থাকলেই ভারত “নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবে” বলে মন্তব্য করেছেন মন্টেক।
এখন দেখার, সঙ্কট কাটাতে ইউরোপ কী করে। |