তরাই-ডুয়ার্স বন্ধ নিয়ে ক্ষোভের মুখে মোর্চা
গ্রীষ্মের ভরা পর্যটন মরসুমের কথা মাথায় রেখে জুন মাসে দার্জিলিং পাহাড়ে বন্ধ ডাকার ‘ঝুঁকি’ নেয়নি গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। কিন্তু বর্ষায় যেখানে পর্যটকদের ভিড় থাকে, সেই তরাই-ডুয়ার্সে তারা ২ জুলাই থেকে টানা ৭২ ঘণ্টার বন্ধ ডাকায় ক্ষোভ দানা বাঁধছে নানা মহলে। তরাই-ডুয়ার্সে এ প্রশ্নও উঠছে যে, অতীতে যেখানে আন্দোলনের চেষ্টা করে সে ভাবে সাড়া মেলেনি, বন্ধ ডেকে সেই এলাকা বিপর্যস্ত করার ‘এক্তিয়ার’ মোর্চার আছে কি? মোর্চা বন্ধ ডাকলে প্রতিরোধের কথাও বলছে বিভিন্ন মহল।
সব মিলিয়ে ঘরে-বাইরে তুমুল চাপের মুখে মোর্চা নেতৃত্ব। তবে তাঁদের কাছে এই মুহূর্তে আশার খবর, তাঁদের দেওয়া আলোচনার প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বস্তুত, জিটিএ-তে ৫টি মৌজা অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশের প্রতিবাদে মুখর হলেও আলোচনার পথ খোলা রেখেই আন্দোলনের ডাক দিয়েছে মোর্চা। তাদের ক্ষোভ এবং দাবি নিয়ে আলোচনার জন্য সোমবার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়ে সময় চেয়েছিল মোর্চা। ঠিক হয়েছে, শ্যামল সেন কমিটির রিপোর্ট নিয়ে আলোচনার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মোর্চার বৈঠক হবে আগামী বৃহস্পতিবার, ১৪ জুন। এখনও পর্যন্ত ঠিক আছে, বৈঠকটি হবে দুপুর ৩টেয়। মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই এ দিন সাংবাদিকদের এই খবর জানান। বৈঠকে মোর্চার তরফে হাজির থাকবেন ২১ জন প্রতিনিধি।
গৌতম দেবের উপস্থিতিতে তৃণমূলে যোগদান জিএনএলএফ,
মোর্চা ও গোর্খা লিগের নেতা-কর্মীদের। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক
মুখ্যমন্ত্রীকে এ দিন প্রশ্ন করা হয়, চুক্তি অনুযায়ী সব পক্ষের তো রিপোর্ট মেনে নেওয়ার কথা। তা হলে মোর্চা কী করে নতুন দাবি তুলছে? মুখ্যমন্ত্রী এ প্রশ্নের কোনও উত্তর দেননি। শুধু বলেছেন, “যা বলার, আগের দিনই মুখ্যসচিব বলেছেন।” মমতা জানান, পাহাড়ের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বৈঠক করবেন ১৫ জুন।
কমিটির সুপারিশ থেকে অবশ্য নিজেদের দূরেই রাখতে চাইছে সিপিএম। দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু এ দিন বলেন, “আমরা কমিটির রিপোর্ট গ্রহণও করছি না, বাতিলও করছি না। কমিটির সুপারিশ কার্যকর করে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা হলে ভাল। আর যদি তা গ্রহণ না করলে শান্তি আসে, তাতেও আপত্তি নেই। পাহাড়ে শান্তি আর উন্নয়নই আমাদের কাছে মুখ্য বিষয়।” তাঁর বক্তব্য, “অতীতে সর্বদল বৈঠকে আমরা বলেছিলাম, নতুন এলাকা অন্তর্ভুক্ত করলে তরাই ও ডুয়ার্সে আশান্তি হবে। কিন্তু বামফ্রন্টের সঙ্গে আলোচনা না করেই তৃণমূল জোট জিটিএ চুক্তি করে। ওরা বলেছিল, এতে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে। শান্তির স্বার্থে তা মেনেও নিয়েছিলাম। এখন কী ভাবে শান্তি আসবে, সরকারকেই দেখতে হবে।”
বিজেপি অবশ্য কমিটির সুপারিশেরই বিরোধিতা করেছে। বস্তুত, শ্যামল সেন কমিটির রিপোর্ট-সহ গোটা জিটিএ চুক্তিই বাতিল করার দাবি তুলেছে তারা। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “গোর্খা পার্বত্য পরিষদই ফিরিয়ে আনা উচিত। কারণ তার মাধ্যমেই পাহাড়-সমস্যার সমাধান সম্ভব।” মোর্চার সমর্থনেই দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রটি বিজেপি-র দখলে। সে সময় বিজেপি-র নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল তারা গোর্খাল্যান্ডের দাবি ‘সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা’ করবে।
কমিটির যে সুপারিশ নিয়ে রাজ্য-রাজনীতির এই চাপানউতোর, তা নিয়েই বন্ধের ডাক দিয়ে তরাই-ডুয়ার্সে তোপের মুখে পড়েছেন মোর্চা নেতৃত্ব। একাধিক রাজনৈতিক দল এবং ২২টি অরাজনৈতিক সংগঠনের মঞ্চ স্পষ্ট বলেছে, বর্ষার সময়ে তরাই-ডুয়ার্সে বন্ধ ডেকে পর্যটকদের ভোগান্তির মুখে ফেলার চেষ্টা বরদাস্ত করা হবে না। ‘ডুয়ার্স-তরাই নাগরিক মঞ্চ’-এর কার্যকরী সভাপতি ল্যারি বসু বলেন, “অতীতে তরাই-ডুয়ার্সে আন্দোলন-বন্ধে সাড়া পায়নি মোর্চা। এই অঞ্চলে মোর্চার কী অবস্থা, তা শ্যামল সেন কমিটির সুপারিশও বলে দিয়েছে। এর পরেও এখানে বন্ধ ডাকার এক্তিয়ার মোর্চার নেই। আশা করি বন্ধ উঠবে। না হলে গণ-প্রতিরোধ হবে।”
আদিবাসী বিকাশ পরিষদের রাজ্য সভাপতি বীরসা তিরকে বলেছেন, “কোনও দল বা সংগঠন বন্ধ ডাকতেই পারে। কিন্তু যেখানে তাদের অস্তিত্ব প্রায় নেই, সেখানে বন্ধ ডাকার নৈতিক অধিকার তাদের থাকে না। মোর্চা নেতারা এটা এখনও কেন বুঝতে পারছেন না, কে জানে! আমজনতা মোর্চার বন্ধকে অতীতেও প্রত্যাখান করেছে, এ বারও করবে।”
বন্ধ হলে প্রশাসনকে কড়া হাতে দমন করার দাবি তুলেছে বাম দলগুলিও। আরএসপি-র জেলা সম্পাদক সুনীল বণিকের কথায়, “জিটিএ পাহাড়ের তিনটি মহকুমাতেই সীমাবদ্ধ থাকুক। পাহাড়ের সমস্যা ডুয়ার্স-তরাইয়ে নিয়ে আসার কোনও এক্তিয়ার মোর্চার নেই।” সিপিএমের জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক কৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায় বলেন, “ডুয়ার্স-তরাইয়ে আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। প্রশাসনকে কড়া হতে হবে।” জলপাইগুড়ি জেলা কংগ্রেস সভাপতি মোহন বসুর বক্তব্য, “ডুয়ার্স বা তরাইয়ে মোর্চাকে বন্ধ করার অধিকার স্থানীয় মানুষ দেননি। শ্যামল সেন কমিটির রিপোর্টও তাই বলেছে। এ বার বর্ষার পর্যটন মরসুমে ডুয়ার্সে গোলমাল হলে কংগ্রেস কর্মীরা প্রতিরোধে করবেন।”
নানাবিধ চাপের মুখে বিব্রত তরাই-ডুয়ার্সের অনেক মোর্চা নেতা। মোর্চা নেতৃত্বের উপরে চাপ অন্য দিকেও। সুকনার এক মোর্চা নেতা তাঁর অনুগামীদের নিয়ে তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন। অতীতে মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটি বন্ধের হুমকি দিলে তরাই-ডুয়ার্সের মোর্চা নেতাদের যে চড়া শোনা যেত, তা এ বার নেই। মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা ডুয়ার্স কমিটির সভাপতি মধুকর থাপা বলেন, “শীর্ষ নেতারা বন্ধ ডেকেছেন। তাতে বর্ষায় ডুয়ার্সের পর্যটন ব্যবসায় বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা রয়েছেই। আমরা ঘোষিত কর্মসূচি মানলেও জবরদস্তির রাস্তায় যাব না। শুধু বন্ধ সফল করার আবেদন করব।” বন্ধ ডাকার এক্তিয়ার প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য, “এই গণতান্ত্রিক অধিকার সকলের রয়েছে। বন্ধ সফল হবে কি না, তা আমজনতা স্থির করবে। সার্বিক পরিস্থিতি আমি বিমল গুরুঙ্গকে জানিয়েছি।”
বস্তুত বর্ষার সময়ে জঙ্গলে ঢোকা বারণ হলেও জুলাইয়ের গোড়া থেকেই লাটাগুড়ি, মূর্তি, জলদাপাড়ার মতো জঙ্গল এলাকায় পর্যটকরা ভিড় জমান। ট্যুর অপারেটররা জানাচ্ছেন, বর্ষা উপভোগ করতে ডুয়ার্স-তরাইয়ের সমতল-জঙ্গলে ফি বছর ভিড় জমান পর্যটকরা। এ রাজ্য তো বটেই, ভিন্ রাজ্য থেকেও ডুয়ার্সের অর্কিড নিয়ে গবেষণা করতে একাধিক দল আসে। গত বছর ডুয়ার্স-তরাইয়ে গোলমালের জন্য বর্ষায় সে ভাবে পর্যটক আসেননি।
এ বার অন্য ছবি। ‘লাটাগুড়ি রিসর্ট ওর্নাস অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক কমল ভৌমিক বলেন, “এ বার ৩০-৪০ শতাংশ (আনুমানিক লাখ খানেক পর্যটক) বুকিং হয়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বন্ধ হলে তার প্রভাব তো পড়বেই।” ডুয়ার্স ও পাহাড়ের ট্যুর অপারেটর তাপস দে-র মতে, শুধু মাত্র পাহাড়ের কথা মাথায় রেখে বন্ধ ডাকার এই সিদ্ধান্ত অনৈতিক। বর্ষায় পর্যটক টানতে বন উন্নয়ন নিগমের বাংলোগুলিতে দু’দিন বুকিং করলে এক দিনের বুকিং বিনামূল্যে দেওয়া হয়। এই সুযোগ হাতছাড়া করেন না বহু পর্যটক। গড়িয়ার অর্ঘ্য চক্রবর্তীর আশঙ্কা, “প্রতি বছর পরিবার নিয়ে বর্ষার সময়ে ডুয়ার্স যাই। এ বার কি যেতে পারব?”

সহ-প্রতিবেদন: অনির্বাণ রায়



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.