স্কুলে অনিয়মিত কেন, বাড়িতে হাজির শিক্ষক
রমের ছুটির মধ্যে সাতসকালেই গ্রামে স্কুলের মাস্টারমশাই, দিদিমণিদের দেখে থ’ সুকুমার-অজয়-মিতালিরা। পরে বুঝল, তাদের খোঁজ নিতেই গ্রামে এসেছেন মাস্টারমশাই, দিদিমণিরা। সোমবার সকালে জঙ্গলঘেরা শালবনির নতুনডিহি, নোনাশোল, ভুরসা গ্রামে এসে স্কুলে অনিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বললেন মৌপাল দেশপ্রাণ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। জানতে চাইলেন, কেন ছেলেমেয়েরা নিয়মিত স্কুলে যায় না, ঠিক কোথায় সমস্যা। সঙ্গে তাঁদের আবেদন, “ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠান। ওরা লেখাপড়া করুক। সমস্যা হলে আমাদের বলুন। এটা তো লেখাপড়া-খেলাধুলোরই বয়স।”
কেন এই উদ্যোগ? স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রসূন পড়িয়া বলেন, “আমাদের স্কুলের একাংশ ছাত্রছাত্রী নিয়মিত স্কুলে আসে না। এ সমস্যা জঙ্গলমহল এলাকার অধিকাংশ স্কুলেরই। অনেকে মাঝপথে পড়াশোনাই ছেড়ে দেয়। আমরা ওদের স্কুলমুখো করার চেষ্টা চালাচ্ছি।” তাঁর কথায়, “স্কুলের সকলে মিলেই এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। অনিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলতে সোমবার থেকেই শিক্ষক-শিক্ষিকারা দু’টি দলে ভাগ হয়ে গ্রামে যেতে শুরু করেছেন।” আপাতত, স্কুলের আশপাশের ২২টি গ্রামে গিয়ে অভিভাকদের সঙ্গে কথা বলার পরিকল্পনা হয়েছে। ওই গ্রামগুলির কোন কোন ছাত্রছাত্রী নিয়মিত স্কুলে আসে না, তার একটি তালিকাও তৈরি করা হয়েছে। নতুনডিহি গ্রামে যেমন স্কুলে অনিয়মিত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১৩, নোনাশোলে ১৬, ভাঙ্গাবাঁধে ৭। জানা গিয়েছে, এই স্কুলে এখন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১ হাজার ৭৮ জন। তাদের মধ্যে প্রায় ৩০০ ছাত্রছাত্রী অনিয়মিত। গরমের জন্য ক্লাসের ছুটি বাড়ানো হয়েছে। তবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের স্কুলে আসতে হবে বলেই জানিয়েছে রাজ্য সরকার। ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি যাওয়ার জন্য এই সময়টাকেই বেছে নিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা।
অভিভাবকদের বোঝাচ্ছেন মৌপাল দেশপ্রাণ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। ছবি: কিংশুক আইচ।
নতুনডিহিতে বাড়ি সুকুমার মাহাতোর। সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সুকুমার স্কুলে যায় না নিয়মিত। কেন? তার বাবা রণজিৎ মাহাতো বলেন, “ছেলের পড়াশোনার দিকে সে ভাবে আগ্রহ দেখি না। আমাদের সামান্য জমি। চাষবাস করেই সংসার চলে। ধার করেও বই কিনে দিয়েছি। নিয়মিত স্কুলে যাওয়ার জন্য আমিও বলি। কিন্তু ও কথা শোনে না। মাঝেমধ্যেই তাই বকাবকিও করি।” যা শুনে শিক্ষক পরিমল মাহাতো বলেন, “বকাঝকা করবেন না। ওদের বুঝিয়ে বলতে হবে। আপনারা একটু নজর রাখলেই দেখবেন ছেলে নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে।” শিক্ষকদের কাছে অবশ্য সুকুমারও জানিয়েছে, সোমবার থেকে স্কুল খুললেই নিয়মিত স্কুলে যাবে। পরিমলবাবুর সঙ্গেই গ্রামে এসেছিলেন শিখা দে, সমীর বিষুই, হারাধন সিংহের মতো শিক্ষক-শিক্ষিকারা। নতুনডিহিতেই বাড়ি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র অজয় মাহাতোর। অজয়র মা পুষ্প মাহাতো বলেন, “ছেলেকে স্কুলে যাওয়ার জন্য বলি। ওকে লেখাপড়া শেখাতেও চাই। জানি না কী হবে।” অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে শিক্ষিকা শিখাদেবী বলছিলেন, “আপনারা তো প্রায়ই মৌপালে যান। আসা-যাওয়ার পথে এক বার স্কুলেও যেতে পারেন। ছেলেমেয়েরা কেমন পড়াশোনা করছে, খোঁজ নিতে পারেন।”
নোনাশোলে বাড়ি মিতালি মাহাতো, মণিবালা মাহাতো, টিঙ্কু মাহাতোদের। সোমবার ওদের অভিভাবকদের সঙ্গেও কথা বলেছেন শিক্ষকেরা। শিক্ষকদের এমন উদ্যোগে খুশি অভিভাবকেরাও। তাঁদের বক্তব্য, লেখাপড়ার মূল্য আমরাও বুঝি। আমরাও চাই, ছেলেমেয়েরা নিয়মিত স্কুলে যাক। নানা কারণে ছেলেমেয়েরা সব সময়ে যেতে চায় না। সংসারের চাপও থাকে। দেশপ্রাণ বিদ্যাপীঠ থেকে এ বার ১১৪ জন মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল। উত্তীণর্র্ হয়েছে ৮৩ জন। সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে অলোক মাহাতো, ৫৯৬। অলোকের বাড়ি নোনাশোলেই। বাবা অজিত মাহাতো চাষবাস করেন। ঘরে পাতা সেলাইয়ের মেশিনও রয়েছে। মা লক্ষ্মীদেবী বধূ। বোন অলোকাও সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। এক সময়ে এই এলাকায় অশান্তিও ছড়িয়েছিল। এখন অবশ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক। শিক্ষক সমীর বিষুই বলছিলেন, “অলোক তো আপনাদেরই গ্রামের ছেলে। মাধ্যমিকে ভাল ফল করেছে। মেধা-বুদ্ধি সকলের সমান হয় না। তবে পড়াশোনাটা চালিয়ে যাওয়া দরকার।”
প্রসূনবাবু বলেন, “অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে ইতিমধ্যেই আমরা ১৮ জন ছাত্রছাত্রীকে ফের স্কুলে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি।” জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, গত বছরের সমীক্ষা অনুযায়ী, পশ্চিম মেদিনীপুরে এখন স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৭ হাজার ৫১১। পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির মধ্যে স্কুলছুট প্রায় ৫ হাজার। আর প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার পড়ুয়া। এই অবস্থায় দেশপ্রাণ স্কুলের উদ্যোগে খুশি জেলা-প্রশাসনও। জেলাশাসক সুরেন্দ্র গুপ্ত বলেন, “ভাল উদ্যোগ। এর ফলে অভিভাবকেরাও সচেতন হবেন।” জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (মাধ্যমিক) সঙ্ঘমিত্র মাকুড় বলেন, “এমন কর্মসূচি নিয়মিত হলেই ভাল হয়।” আর সর্বশিক্ষা মিশন প্রকল্পের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা আধিকারিক শাশ্বতী দাস বলেন, “সত্যিই ভাল উদ্যোগে। আমরাও নানা ভাবে স্কুলছুটদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি।” শুধু ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোই নয়, প্রতিটি বাড়িতে শৌচাগার গড়ে তোলার জন্যও অভিভাবকদের কাছে আবেদন রাখছেন শিক্ষকেরা। গত বছর এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মৌপাল ও তার আশপাশ এলাকার ২ হাজার ৮১২ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে মাত্র ৩১৮ জনের বাড়িতে শৌচাগার রয়েছে। মাত্রই ১১ শতাংশ।
শিক্ষার সঙ্গে স্বাস্থ্য-সচেতনতা প্রসারেও এগিয়ে এসে দৃষ্টান্ত তৈরি করলেন দেশপ্রাণ স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.