প্রবন্ধ ২...
আর্সেনিকের বিপদ বাড়ছে, কলকাতা পুরসভা নির্বিকার
সেই ট্র্যাডিশন... আমরা করব না। আবার অন্য কেউ করলে তারও সমালোচনা করব, তার সম্পর্কে নানা কটু মন্তব্য করব। আবার বিপদে পড়ে সেই তথ্যকেই ‘নিজেদের’ বলে জাহির করে কেন্দ্র থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা করব। আর্সেনিক নিয়ন্ত্রণে তিন দশকের সেই ধারাই এখনও চলছে রাজ্যে। বিশেষ করে কলকাতা পুরসভা এলাকায়। রাজ্য সরকার তবু ন’টি জেলার আর্সেনিক পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার ভার দিয়েছে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরকে। তার মাথায় আর্সেনিক টাস্ক ফোর্স। সেই টাস্ক ফোর্স কলকাতা পুরসভার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম ভাগকে আর্সেনিক-প্রবণ বলে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু কলকাতা পুরসভা এখনও আর্সেনিক চিহ্নিত করার কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি। এটা যে কোন বিভাগের দায়িত্ব, তা জানেন না পুরকর্তারা। তাঁদের কেউ কেউ বলছেন, যেহেতু দূষণ জলে, তাই জল সরবরাহ বিভাগেরই তা দেখভাল করার কথা।
১৯৮৩ সালে স্কুল অব ট্রপিকাল মেডিসিন-এর চর্ম রোগ বিভাগে আসা এক রোগীকে পরীক্ষা করে বিভাগের তৎকালীন প্রধান ক্ষিতীশচন্দ্র সাহা প্রথম জানতে পারেন যে ওই ব্যক্তি আর্সেনিক দূষণের শিকার। আর তা যে নলকূপের জলের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করছে তা-ও জানিয়েছিলেন তিনি। তৎকালীন রাজ্য সরকার সে কথায় আমল দেয়নি। কিন্তু এর পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সমীক্ষা করে রিপোর্ট দিল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এ বিষয়ে সরব হল। বিশ্বের নজর পড়ল পশ্চিমবঙ্গের আর্সেনিক দূষণে। মোকাবিলায় তৈরি হল টাস্ক ফোর্স। কেন্দ্রের টাকা এল। অর্থ নিয়ে এল ইউনিসেফ। কিন্তু সরকারি কমিটি থেকে বাদ ক্ষিতীশবাবু। ব্রাত্য করে রাখা হল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালেয়র স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ-এর প্রধান গবেষক দীপঙ্কর চক্রবর্তীকে।
সেটা ১৯৯১। পরের কুড়ি বছর আর্সেনিক নিয়ন্ত্রণে কম টাকা আসেনি রাজ্যে। নিজেদের মতো সমীক্ষা করে সেই টাকা কী ভাবে ব্যয় করা হবে তার নির্ঘণ্টও তৈরি হল। কমিটি হল, দফায় দফায় বৈঠক হল পাঁচতারা হোটেলে, আর্সেনিক আক্রান্ত মানুষদের তেমন লাভ হল না। ১৯৯৩ সালে দীপঙ্করবাবুরা পুরসভার যাদবপুর এলাকার গভীর নলকূপের জলে পেলেন বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক। রোগীর শরীরে মিলল দূষণের চিহ্ন। পুরসভা সেই রিপোর্টকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিল। ২০০০ সালে ফের দক্ষিণ কলকাতা ও শহরতলির নলকূপে বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক পেল স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ। পুরসভা তা মানল না। পুরকর্তারা বললেন, সমীক্ষার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে তাঁদের সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু ওই রিপোর্টকে ভিত্তি করে সমীক্ষা চালিয়ে রাজ্যের আর্সেনিক টাস্ক ফোর্স যাদবপুর-সহ দক্ষিণ কলকাতার বিস্তীর্ণ এলাকাকে আর্সেনিকপ্রবণ বলে ঘোষণা করেছে বছর দশেক আগে। সেই সব অঞ্চলে গভীর নলকূপ বসানো নিষিদ্ধ করতে বলেছে টাস্ক ফোর্স। যেগুলি আছে সেগুলির জল নিয়মিত পরীক্ষারও সুপারিশ রয়েছে। কিন্তু কলকাতার ভূগর্ভের জলস্তরের কোথায় কী অবস্থা তা নিয়ে সমীক্ষার পরিকাঠামোই তৈরি করতে পারেনি পুরসভা। তৈরি হয়নি নিয়মিত জল পরীক্ষার পরিকাঠামোও।
২০১১’র ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতার ভূগর্ভের অবস্থা নিয়ে সমীক্ষা করে কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা কেন্দ্রীয় ভূ-জল নিগম। কলকাতা পুরসভার কাছ থেকে সমীক্ষকরা যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন তাতে দেখা যাচ্ছে মহানগরীতে শেষ বারের মতো নলকূপের জলে আর্সেনিকের পরিমাণ মাপা হয়েছিল ২০০৩’র ১৫ জুন। ওই তথ্য মতো ২০০০’র ২ মে থেকে পরবর্তী তিন বছরে মহানগরীর ৭৭টি গভীর নলকূপের জলে আর্সেনিকের পরিমাণ মেপেছিল পুরসভা। যে সব গভীর নলকূপের জল পুরসভা মেপেছে তার শতকরা ৯০ ভাগই তাদের বসানো নলকূপ বা সরকারি ভবনের। কোনও বহুতল বা বেসরকারি ভবনের নলকূপের জল তারা পরীক্ষা করেনি। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, আলিপুরের প্রশাসনিক ভবন, কেন্দ্রীয় সরকারের আবাসন, আবহাওয়া দফতর, জাতীয় গ্রন্থাগারের জলে বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক পাওয়া গিয়েছিল সমীক্ষায়। যাদবপুর-টালিগঞ্জ এলাকার প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড, প্রিন্স গোলাম হোসেন শাহ রোড, এনএসসি বসু রোড, ব্রহ্মপুর, অরবিন্দ পার্কের কিছু গভীর নলকূপের জলেও পাওয়া গিয়েছিল বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক। পুরসভার দাবি, সেগুলি বন্ধ করে দিয়েছে তারা। কিন্তু ওই সব নলকূপের আশপাশে আর যে সব বাড়ি, স্কুল, হাসপাতাল বা বহুতলে গভীর নলকূপ ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলির জল পরীক্ষার ব্যবস্থা পুরসভা করেনি। প্রসঙ্গত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজি এবং বসু বিজ্ঞান মন্দিরের কয়েক জন গবেষকও গবেষণা করছেন আর্সেনিক দূষণ নিয়ে। তাঁদের কাছে কলকাতা পুরসভা কোনও সময়েই পরামর্শ নিতে যায়নি। যেচে সাহায্য দিতে গিয়েছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ-এর গবেষকরা, তাঁদের সমীক্ষার যথার্থতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে পুরসভা।
যাদবপুর এলাকায় বাইপাসের দু’ধারে যথেচ্ছ ভাবে তৈরি হয়েছে বহুতল। সবাই নির্ভরশীল ভূগর্ভের জলের উপরে। গভীর নলকূপ নিয়ন্ত্রণ করতে ২০০৫ সালে রাজ্যে একটি আইন হয়। তার তোয়াক্কাই করেনি পুরসভা। শহরেরর বিভিন্ন এলাকায় বছরে জলস্তর কতটা কমছে, কোন এলাকায় কোন কোন বিপজ্জনক মৌল ভূ-জলে মিশে যাচ্ছে তার নিজস্ব কোনও রেকর্ডই নেই পুরসভার। তারা পুরোপুরি নির্ভরশীল কেন্দ্রীয় ভূ-জল নিগমের উপরে। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ওই নিগমের সুপারিশ ছিল, কলকাতায় ভূগর্ভের জলস্তর যে ভাবে নেমে যাচ্ছে তাতে গভীর নলকূপ বসানো অবিলম্বে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এখন যে সব গভীর নলকূপ আছে, ধাপে ধাপে সেগুলি বন্ধ করতে হবে। কোথায় কত গভীর নলকূপ বসানো হল, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পুরসভা একটা সুপারিশও পালন করেনি।
আর সম্প্রতি তারা যা করল তাতে কেন্দ্রীয় ভূ-জল নিগমের গবেষকদের অনেকেই হতবাক। গঙ্গার পরিশোধিত জল যাদবপুর বিধানসভা এলাকার বড় একটা এলাকায় এখনও সরবরাহ করতে পারে না পুরসভা। পানীয় জলের জন্য ওই সব এলাকার বাসিন্দাদের ভরসা গভীর নলকূপ। তীব্র গরমে যাদবপুর পুরসভা এলাকায় পানীয় জলের সঙ্কট দেখা দেওয়ায় পুরসভা ফের সেখানে গভীর নলকূপ খোঁড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত যে বিজ্ঞানসম্মত নয় তা বোঝাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজের গবেষকেরা যাদবপুর-টালিগঞ্জ এলাকার ছয়টি (তার পাঁচটি পুরসভার) গভীর নলকূপের জল পরীক্ষা করেছিলেন। প্রতিটি নলকূপের জলের নমুনাতেই বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক পেয়েছিলেন ওই সমীক্ষকরা। তাঁরা ভেবেছিলেন, সেই সমীক্ষা রিপোর্ট দেখে গভীর নলকূপ বসানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করবে পুরসভা।
১৯৯৩, ২০০০ সালের পরে এবার ২০১২। ফের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা রিপোর্টকে আমলই ছিল না পুরসভা। বোঝা গেল ‘পরিবর্তন’-এর রাজ্যে কলকাতা পুরসভার রয়েছে আগের জায়গাতেই!

তথ্যসূত্র: Hydrological Study in Kolkata Municipal Corporation Area with special reference to the declining Piezometric Level through groundwater development, Scientific Report, Series D, No- 230, Central Ground Board, Eastern Region, Kolkata, February 2011


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.