সকাল থেকে বাড়ির যাবতীয় কাজ সামলানো। হৃদরোগী মায়ের সেবা করা। সব শেষে দীর্ঘ ৭ কিলোমিটার পথ সাইকেল চালিয়ে স্কুলে পৌঁছনো। স্কুল থেকে ফিরে ফের লেগে পড়া বাড়ির কাজে। তারপর অনেক রাতে লণ্ঠনের টিমটিমে আলোয় শুরু হতো তাঁর পড়াশোনা। মেয়ের প্রত্যেকদিনের রুটিনই ছিল এই। কিন্তু কোনও প্রতিবন্ধকতাই আটকে রাখতে পারেনি তাঁকে। মুরারাইয়ের প্রত্যন্ত গ্রাম মহুরাপুরের সেই দীপ্তি ঘোষ এ বারে উচ্চ মাধ্যমিকে কলা বিভাগ থেকে পেয়েছে ৪১৬ নম্বর।
রাজগ্রাম মহামায়া হাইস্কুলের এই ছাত্রীর প্রাপ্ত নম্বরটিই স্কুলে এ বারে সর্বোচ্চ। বাবা অপূর্ব ঘোষ পেশায় দিনমজুর। তিনি জানালেন, দীপ্তি মাধ্যমিকে খুব ভাল ফল করার পর দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের সাহায্যে হুগলির উত্তরপাড়ায় বিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু এই সামান্য আয়ে মেয়েকে পড়াতে পারেননি অপূর্ববাবু। মাঝপথেই উত্তরপাড়া থেকে ফিরতে হল দীপ্তিকে। বিজ্ঞান নিয়ে আর পড়া হয়নি তাঁর। রাজগ্রাম মহামায়া হাইস্কুলে কলা বিভাগে ভর্তি হয় সে। ছিল না কোনও প্রাইভেট টিউটরও। স্কুলের শিক্ষকরাই এতদিন সব রকমের সাহায্য করেছেন। কিন্তু এখন এই ফলাফলের পর মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত অপূর্ববাবু। তাঁর কথায়, “মেয়েকে কোথায় ভর্তি করব, এরপরের পড়াশানার খরচই বা কীভাবে জোগাড় করব কিছুই বুঝতে পারছি না।” দুঃস্থ পরিবারের এই মেধাবী ছাত্রীর ভবিষ্যতের ইচ্ছা অবশ্য ভূগোল নিয়ে পড়ে শিক্ষক হওয়া। কিন্তু তাঁর এই স্বপ্ন কীভাবে সত্যি হবে জানেন না কেউই। এলাকার ব্যবসায়ী সমিতির গোবিন্দলাল বিশ্বাসরাও দীপ্তির পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু উচ্চ শিক্ষায় সেটা যে যথেষ্ট নয় জানেন অপূর্ববাবু। দীপ্তির স্কুলের প্রধান শিক্ষক শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাই বললেন, “দীপ্তির স্বপ্ন পূরণের জন্য আমাদের সবার এগিয়ে আসা উচিত।”
দীপ্তি ঘোষ।
ঊর্মিলা সেন।
অন্যদিকে, পেটের টানে কখনও রাজমিস্ত্রি কখনও বা দর্জির কাজ নিয়ে বের হতে হয় উত্তম সেনকে। নিজের খাওয়াপরার খরচ বাঁচিয়ে বাড়িতে যেটুকু পাঠাতে পারেন তা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের ভাল ভাবে ভাতকাপড়ের সংস্থান হয় না। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালানো তো দূরের কথা। তাই সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই তাঁর মেয়ে ঊর্মিলা ও ছোট ছেলে গৌরকে চলে আসতে হয় ময়ূরেশ্বরের তেরাতরী গ্রামে মামার বাড়িতে। সেখানকারই লোকপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কলাবিভাগে ৪১৪ নম্বর পেয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ঊর্মিলা। দীপ্তির মতোই তাঁরও স্বপ্ন ভূগোল নিয়ে পড়াশোনা করে স্কুল কিংবা কলেজে শিক্ষকতা করার। কিন্তু বাড়ির এই আর্থিক অবস্থায় আদৌ তা সম্ভব হবে কি না জানে না ঊর্মিলা।
তাঁদের আসল বাড়ি মুশির্দাবাদের খরজুনা গ্রামে। অভাবের সংসারে আরেক বোনকে নিয়ে রয়েছেন মা লতিকাদেবী। বাবা বর্তমানে পটনায় দর্জির কাজ করেন। সামান্য আয়ে তিনি যা পাঠান তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় লতিকাদেবীকে। তাই ছেলেমেয়েকে পাঠিয়ে ছিলেন বাপের বাড়িতে। কিন্তু এ বার দুশ্চিন্তা চেপে বসেছে মা ও মেয়ের মনে। মামাদেরও সংসারে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ নেই। নিজেদের ছেলেমেয়েরা স্কুল কলেজে পড়ে। ফলে ঊর্মিলা ভাল রকমই জানেন, তাঁর উচ্চ শিক্ষার খরচ জোগাতে গিয়ে মামাদের উপর চরম চাপ পড়বে। যদিও মামা মধুসূদন দত্তর বিশ্বাস, “যেমন করে পারি নিজেদের ছেলেমেয়ের পাশাপাশি ভাগ্নে-ভাগ্নিরও ব্যবস্থা করব।” কিন্তু মামাদের উপর ঊর্মিলা আর বেশি চাপ দিতে চান না। এই অবস্থায় তাঁর ভাবনা, “যদি কোনও সাহায্য পাই তাহলে ভাল হয়। না হলে টিউশনি বা কোনও অস্থায়ী কাজ খুঁজে নিয়ে পড়াশোনা চালাতে হবে।”
প্রতিবেদক: অপূর্ব চট্টোপাধ্যায় ও অর্ঘ্য ঘোষ।
ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি ও নিজস্ব চিত্র।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.