ছেলে বা মেয়ে পড়াশোনায় ভাল, এ নিয়ে গর্ব ছিল তাঁদের। উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল ফল করে সন্তানেরা মুখ রেখেছেন। কিন্তু ফল বেরোনোর পর থেকে আনন্দের পাশাপাশি চিন্তারও অন্ত নেই তাঁদের। সবারই চিন্তাটা একই রকমের, এর পরে পড়াশোনার খরচ জোগাড় হবে কোথা থেকে!
কাটোয়ার ভাটনা গ্রামের নুরজাহান খাতুনের দুই দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল নাবালিকা অবস্থায়। তারও বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলেন বাড়ির লোকজন। রুখে দাঁড়ায় নুরজাহান। সাফ জানিয়ে দেয়, সে পড়তে চায়। এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে নুরজাহান ৩৮৭ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পরে বাড়ির লোকজনও মানছেন, বিয়ে দেওয়া হলে তা ভুল হত।
নুরজাহানের বাবা দিল মহম্মদ শেখ শারীরিক প্রতিবন্ধী। সামান্য জমিতে মজুর দিয়ে চাষবাস করে যা রোজগার হয় তাতে কোনও মতে সংসার চলে। তাঁর চার মেয়ে ও এক ছেলে। তাদের পড়াশোনা করাতে গিয়ে বাজারে বেশ কিছু টাকা দেনা হয়ে গিয়েছে। স্কুলে পড়ার সময়েই দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। নুরজাহান বলেন, “আমার বিয়ের ব্যাপারেও বাড়িতে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু আমি জানিয়েছিলাম, পড়তে চাই।” ওকড়সা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এ বার পাশ করেছে সে। বাড়ি থেকে ছ’কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসতে হত তাকে। তাঁরা নুরজাহানের বিয়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন, তা স্বীকার করে দিল মহম্মদ বলেন, “ওর নাছোড় মনোভাবে আমরা পিছিয়ে যাই। এখন আমরা চাই, ও যত দূর ইচ্ছে পড়ুক।” আর নুরজাহান বলে, “আমাকে পড়াতে গিয়ে বাবার অনেক ধার হয়েছে। পড়াশোনা শিখে শিক্ষিকা হয়ে সেই ঋণ মেটাতে চাই।” |
|
|
|
|
পরিচয় সামন্ত। |
নুরজাহান খাতুন। |
ঈপ্সিতা মোদক। |
প্রদীপ বৈরাগ্য। |
|
ছোট থেকেই নাটক, আবৃত্তি, তাৎক্ষনিক বক্তৃতা করে নানা পুরস্কার পেয়েছে রায়নার স্বামী ভোলানন্দ বিদ্যায়তনের ছাত্র পরিচয় সামন্ত। পড়াশোনাতেও সে বরাবরই ভাল। কিন্তু বাড়িতে অভাবের কারণে নাটক, আবৃত্তির পাট আগেই চুকেছে। এর পরে আর পড়াশোনাও করতে পারবে কি না, সে নিয়েই শঙ্কায় রয়েছে সে। পরিচয় এ বার ৪২০ পেয়ে পাশ করেছে। সে বলে, “ডাক্তার হয়ে গরিবদের চিকিৎসা করার স্বপ্ন দেখি। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর সফল হবে বলে মনে হচ্ছে না।”
পরিচয়ের বাবা কাজল সামন্ত টিউশন পড়ান। কিন্তু সেই রোজগারে কোনও রকমে দু’বেলা খাওয়া জোটে বলে জানান তিনি। ছেলের কৃতিত্বে প্রাণ খুলে হাসতেও পারছেন না তিনি। তাঁর কথায়, “টাকার অভাবে ছেলেকে এ বছর জয়েন্ট এন্ট্রান্সেও বসাতে পারিনি। এত বইপত্র, ভাল শিক্ষক জোটাব কী করে।” স্কুলের প্রধান শিক্ষক মৃণালকান্তি নন্দী বলেন, “ছেলেটির পরিবার দরিদ্র। আমরা যতটা পেরেছি সাহায্য করেছি। তবে এ বার তাঁরা কলেজের খরচ কী ভাবে জোগাবেন, তা নিয়ে আমরাও চিন্তায় আছি।”
কালনা ১ ব্লকের কালনা গ্রামে টিনের চালের একটি ছোট ঘরে তিন জনের সংসার প্রদীপ বৈরাগ্যের। হরিনাম সংকীর্তন করে যা রোজগার হয় তাতে সংসার চলে না। তাই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে তাঁর স্ত্রী প্রতিমাদেবীকে। চরকায় সুতো কেটে শুধু সংসার চালানো নয়, ছেলের স্বপ্নও বুনছেন তিনি। তাঁদের ছেলে পার্থ এ বার উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে ৪৪৫ নম্বর পেয়ে। জয়েন্ট এন্ট্রান্সের মাধ্যমে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগও রয়েছে তার। প্রতিমাদেবী বলেন, “সুতো কেটে এত দিন ছেলের পড়ার খরচ জোগাচ্ছিলাম। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সুযোগ পাওয়ার পরে ভয় হচ্ছে। জানি না, ছেলেকে পড়াতে পারব কি না।”
পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতে নিজে পড়ার পাশাপাশি পার্থ টিউশনও পড়াত। উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল ফলের কৃতিত্ব সে দিচ্ছে শিক্ষকদের। তার কথায়, “শিক্ষকেরা বিনা বেতনে বা অর্ধেক বেতনে আমায় পড়িয়েছেন। বই কেনা থেকে শুরু করে সব রকম সাহায্য করেছেন। তাঁদের সাহায্য ছাড়া এমন ফল হত না।”
সামান্য চাষবাস করে সংসার চালান পূর্বস্থলীর নাদনঘাটের মঙ্গলময় মোদক। তিনিও চিন্তিত মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে। তাঁর মেয়ে, স্থানীয় রামপুরিয়া হাইস্কুলের ছাত্রী ঈপ্সিতা এ বার কলা বিভাগ থেকে ৪৪৭ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। সে জানা, মাধ্যমিকে ভাল ফল করার সুবাদে ছ’হাজার টাকা ভাতা পেয়েছিল সে। সেই টাকায় উচ্চ মাধ্যমিকের পড়াশোনার খরচ অনেকটাই মিটেছে। কিন্তু এ বার কী হবে, সে নিয়ে তার চিন্তার অন্ত নেই। মঙ্গলময়বাবুও বলেন, “আমি সামান্য চাষি। সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। কলেজে পড়ানোর খরচ অনেক। জানি না, মেয়েকে পড়াব কী ভাবে।”
ঈপ্সিতার এর পরে ইংরেজি নিয়ে পড়ার ইচ্ছে রয়েছে। ভবিষ্যতে কলেজ শিক্ষিকা অথবা প্রশাসনিক কাজে যোগ দেওয়ার ইচ্ছে রয়েছে তার। তার কথায়, “ইচ্ছে তো রয়েছে। কিন্তু কোনওটাই হবে কি না, জানি না।”
|
(প্রতিবেদন: রানা সেনগুপ্ত, কেদারনাথ ভট্টাচার্য ও সৌমেন দত্ত)
—নিজস্ব চিত্র। |