কেউ ইটভাটায় কাজ করত, কেউ রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে। কেউ বানাত ধূপ। সব্বাই স্কুলছুট। এদের আবার স্কুলে ফেরানোই তাঁর ব্রত। তার পর ছেলেমেয়েরা পাশ করলে তাঁর আনন্দ দেখে কে?
শ্যামপুরের গুজারপুর শিবগঞ্জ বিশালাক্ষি হাইস্কুল থেকে এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল নম্বর পেয়ে পাশ করেছে প্রদীপ্ত মণ্ডল, প্রিয়া দাস, প্রিয়াঙ্কা দাস এবং অরুণ থান্ডার। চার জনেই মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে পাশ করে পড়াশোনায় ইতি টানতে বাধ্য হয়েছিল। ওদের স্কুলে ফিরিয়ে আনেন প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক মনোজিৎ দত্ত।
ফলাফল? স্কুল থেকে এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে প্রদীপ্ত। ৫০০-য় ৩৭৯। ৭০%-এর বেশি নম্বর পেয়েছে প্রিয়া এবং প্রিয়াঙ্কা। অরুণ ৬৪.৬ %। চার জনেরই এক কথা “স্যার না থাকলে পড়া ছেড়ে দিতেই হত।”
কেন? মালঞ্চবেড়িয়ার বাসিন্দা প্রদীপ্ত ২০১০ সালে গুজারপুর সুরেন্দ্রনাথ বিদ্যাপীঠ থেকে মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে পাশ করেও টাকার অভাবে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারেনি। বাবার সঙ্গে ইটভাটার কাজে লেগে যায় সে। প্রথম বিভাগে পাশ করেছিল দুই বোন প্রিয়া আর প্রিয়াঙ্কাও। অভাবে পড়া ছেড়ে ধূপ তৈরি শুরু করেছিল তারা। |
অরুণের বাড়ি চাউলখোলা এলাকায়। বাবা মারা গিয়েছেন। সংসারের হাল ধরতে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ জুটিয়ে নিয়েছিল সে। এদের সকলকে ধরে-বেঁধে ফের স্কুলে ভর্তি করান মনোজিৎবাবু। ছাত্রছাত্রীরা কে কেমন পরিবেশে বড় হচ্ছে, কার বাড়ির অবস্থা কেমন এ সবের খবর রাখাকে শিক্ষকের দায়িত্ব বলেই বরাবর গণ্য করেছেন তিনি।
১৯৭৪ সালে শ্যামপুরের দরিদ্র সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় কোলিয়া আমির আলি হাইস্কুলে শিক্ষক হিসাবে শুরু করেছিলেন মনোজিৎবাবু। দিনের পর দিন দেখেছেন, ছেলেমেয়েগুলো খেতে-পরতে পায় না। বহু ছাত্রছাত্রীকে পড়ার খরচ জুগিয়েছেন তখন থেকেই। স্কুলে লাইব্রেরি তৈরি করেছিলেন নিজের উদ্যোগে। তার পরে এলেন বিশালাক্ষি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হয়ে। ঘুরে ঘুরে স্কুলছুটদের স্কুলে ফেরাতেন। বর্তমান প্রধান শিক্ষক অপূর্ব দাসও বলেন, “বহু ছেলেমেয়েকে মূল স্রোতে ফেরানোয় মনোজিৎবাবুর ভূমিকা খুবই প্রশংসনীয়।” সেই পড়ুয়াদের অনেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের সাফল্য গর্বিত করেছে স্কুলকে আর বুক ভরে গিয়েছে মনোজিৎবাবুর। বললেন, “ছাত্ররা ভাল ফল করে সামনে এলে ওদের নিজের সন্তানের থেকে বেশি আপন মনে হয়।”
শিক্ষক আর ছাত্রের এমন দৃষ্টান্তের কথা শুনে অভিভূত সমাজতত্ত্ববিদ আন্দ্রে বেতেই। বললেন, সব সমাজে কমবেশি বৈষম্য আছে। অন্যান্য জায়গায় এ জাতীয় উদ্যোগ বেশি দেখা যায়। “আমাদের সমাজে বৈষম্য একটু বেশিই। তবু সমাজের কল্যাণকারী ভূমিকার প্রতি আস্থা থাকলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেক কিছু করা যায়।” বেতেই মনে করিয়ে দেন দারিদ্রের সঙ্গে বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার লড়াইয়ের কথা। তাঁরও পড়াশোনা চালানোর মূল সাহায্য এসেছিল পরিবারের বাইরে থেকেই। “সমাজের অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসা ছেলেমেয়েদের বিকাশে উৎসাহ দেওয়াটা খুবই প্রয়োজন।” |
প্রদীপ্ত মণ্ডল, অরুণ থান্ডার, প্রিয়া দাস এবং প্রিয়াঙ্কা দাস। |
এই ‘উৎসাহ’ আসবে কী ভাবে? মনোজিৎবাবু বুঝেছিলেন, পেটে ভাত না জুটলে পড়ুয়ারা স্কুলমুখো হবে না। ২০০৬ সালে কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে স্কুলের ছেলেদের জন্য তাই একটা হস্টেল তৈরি করেন তিনি। সেখানে বর্তমানে ১৪ জন পড়ুয়া থাকে। তাদের তৈরি ফিনাইল, ধূপ বিক্রির টাকা তাদের বাড়িতেও পাঠানো হয়।
২০০৮ সালে মনোজিৎবাবু বিশালাক্ষি হাইস্কুল থেকে অবসর নেন। এখন যোগ দিয়েছেন জগাছার উনসানি জুনিয়র হাইস্কুলে। সপরিবার বেহালায় থাকেন। আগের স্কুলের হস্টেলের খরচ এখনও জোগাচ্ছেন। “ভাল ছেলেমেয়েরা টাকার অভাবে পড়া ছেড়ে দেবে, এটা মানতে পারি না। যা পারি, করি।”
মনোজিতের জন্য গর্বিত তাঁর পরিবার। মনোজিৎ গর্বিত ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। আন্দ্রে বেতেই বারবার বলছিলেন, “শিক্ষকের পাশাপাশি এদের কৃতিত্বও কম নয়।” প্রদীপ্তদের সামনে এখনও অনেক লড়াই। ‘স্যার’ পাশে আছেন।
আড়াই বছর বয়সে বাবা মারা গিয়েছিলেন। দাদু সতীশচন্দ্র দত্তের কাছেই মানুষ। “দাদু বলতেন, মানুষের পাশে দাঁড়াও। আনন্দ পাবে।” সেই আনন্দ-সন্ধানেই আছেন মনোজিৎ। |