আর এস এসই এখন বি জে পি’কে অক্সিজেন দিতে পারে।
সে জন্য তাকে এই দলটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। লিখছেন
উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় |
একেই বলে এক বালতি দুধে এক ফোঁটা চোনা। যে দিন পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এন ডি এ জোট ভারত বন্ধ ডাকল, সে দিনটাই কিনা লালকৃষ্ণ আডবাণী বেছে নিলেন আপন দলের সমালোচনার জন্য! নেতৃত্বের এমন সমালোচনা বা দ্বন্দ্ব সংঘ পরিবারের সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান ও ঐতিহ্যের প্রেক্ষিতে নতুন নয়। কার্যত আর এস এসের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার অভিপ্রায় থেকেই এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত।
১৯৭৭-এ জনতা পার্টিতে মিশে গিয়েছিল জনসংঘ। প্রবল ইন্দিরা-বিরোধী হাওয়ার সওয়ার হয়ে তৎকালীন জনসংঘের সভাপতি আডবাণী যোগ দিলেন জনতা মন্ত্রিসভায়। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই ঐক্যের দফারফা। লোহিয়াপন্থী রাজনারায়ণ এবং মধু লিমায়ের নেতৃত্বে কয়েক জন বলতে লাগলেন যে, দ্বৈত সদস্যপদ চলবে না। অর্থাৎ, সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারী জনতা পার্টিতে থাকব, আবার আর এস এসের মতো অতি ডানপন্থী সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখব দুটোই একসঙ্গে সম্ভব নয়। সংঘের পুরনো প্রচারক আডবাণী, বাজপেয়ীরা বেরিয়ে এলেন সরকার থেকে। ছাড়লেন জনতা পার্টির সদস্যপদ। ১৯৮০-তে জন্ম নিল ভারতীয় জনতা পার্টি। সেই সঙ্গে স্বীকৃতি পেল এই বিশেষ রাজনৈতিক দলটির উপর আর এস এসের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ। সেই থেকে অদ্যাবধি।
অথচ জনসংঘ তৈরির গল্প কিছুটা পৃথক। সেই সময়ের আর এস এসের প্রাণপুরুষ মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর কোনও অবস্থাতেই দলভুক্ত হতে চাননি। অনেকেই বলেন যে, ১৯৫১ সালে জনসংঘ প্রতিষ্ঠার সময়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় গোলওয়ালকরের সার্বিক সমর্থন পেয়েছিলেন। ভুল ধারণা। ১৯৫১-র ২১ অক্টোবর শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে জনসংঘ আবির্ভূত হয়। সংঘ প্রচারক কে আর মালকানি নতুন দলের ম্যানিফেস্টো রচনা করেছিলেন। গোলওয়ালকর বিরোধিতা করেননি, সমর্থনও করেননি।
ওই বছরই ২৯ অক্টোবর সংঘ মুখপত্র অরগানাইজার-এ স্পষ্ট ভাষায় গোলওয়ালকর লেখেন, প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আর এস এস কোনও রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করবে না। তবে সদস্য ও প্রচারকদের স্বাধীনতা থাকবে নিজস্ব ইচ্ছানুযায়ী রাজনৈতিক সংযোগের। বস্তুত ‘সামাজিক’ হিন্দুত্বের ধারণা আঁকড়ে তিনি ‘রাজনৈতিক’ ভারতকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। তাই দলীয় অবস্থান তাঁর চিন্তায় বিশেষ গুরুত্ব পায়নি।
গোলওয়ালকরের অনুগামী হয়েও কে আর মালকানি, বলরাজ মাধব প্রমুখ তরুণ তুর্কিরা সেই সময়ে ‘শ্রী গুরুজি’র সঙ্গে তর্কে মেতেছিলেন। এঁদের মধ্যে সর্বাধিক বিশিষ্ট হলেন দীনদয়াল উপাধ্যায়। তিনিই মূলত ‘সামাজিক’ ও ‘রাজনৈতিক’ হিন্দুত্বের সমন্বয় সাধন করলেন। শ্যামাপ্রসাদের অকালমৃত্যুর পরে দীনদয়ালই হয়ে উঠলেন হিন্দুত্ববাদীদের রাজনৈতিক গুরু। তবে তিনিও বেশি সময় পাননি। জনসংঘের সার্বিক নেতৃত্ব নেওয়ার পরে যখন তাঁর চিন্তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, সেই সময় আকস্মিক ভাবে তাঁর মৃত্যু হয় ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮-তে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বি জে পি-র কাছে দীনদয়ালই রাজনৈতিক পথপ্রদর্শক। গোলওয়ালকর আর এস এসের দ্বারা রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। দীনদয়াল চাইলেন দলীয় কর্মসূচি নিয়ন্ত্রিত হোক সংঘের অভিপ্রায়ে। এর পরিণতিতে নাগপুরের সঙ্গে বি জে পি নেতৃত্বের একটি অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক স্থাপিত হল, যা দল ও সংঘ, উভয়েরই ক্ষতি করেছে। শ্যামাপ্রসাদের আধুনিকতা ও গোলওয়ালকরের ‘হিন্দুত্ব’র মধ্যে যে ব্যবধান ছিল, তা উভয়কেই বিশিষ্টতা প্রদান করেছিল। সংঘের চাপে মাথা নত করে বি জে পি যেমন হারাতে বসেছে তার স্বতন্ত্র সত্তা, সংঘও তেমনই আর ক্ষমতার রাজনীতির বাইরে নয়। উভয়েরই অবস্থানগত নৈতিক দৃঢ়তা শিথিল হয়েছে। সংঘের শূন্যস্থান ভরাট করতে এগিয়ে এসেছে টিম অণ্ণা। বি জে পি-র সাংগঠনিক সমস্যা সামলাতেই ব্যস্ত আর এস এস প্রধান মোহন ভাগবতকে তাই অণ্ণা হজারের অনশনে মাঠ ভরাতে লোক পাঠাতে হচ্ছে।
তবে বি জে পি-র সঙ্গে আর এস এস নেতৃত্বের ঠোকাঠুকি একেবারেই হয়নি তা নয়। বস্তুত অটলবিহারী বাজপেয়ী ছিলেন এমনই এক জন প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাজনীতিক, যিনি সর্বদাই নাগপুরের কথায় ওঠাবসা করতেন না। বাজপেয়ীকে আধুনিক সেকুলার মুখ হিসেবে তুলে ধরা হলেও তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ সংঘ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করত। বাজপেয়ীও হাল ছাড়ার লোক ছিলেন না। কাশ্মীর প্রসঙ্গে পারভেজ মুশারফের সঙ্গে তাঁর সমন্বয় এত দূর এগিয়েছিল যে শেষ মুহূর্তে মরিয়া সংঘ পরিবার আডবাণীকে দিয়ে তাঁকে নিরস্ত করে। সংঘের স্বদেশি অর্থনৈতিক চিন্তাকেও বাজপেয়ী কোনও দিন গুরুত্ব দেননি। আর্থিক সংস্কার, বিদেশি বিনিয়োগ প্রভৃতি প্রশ্নে সংঘ প্রচারক গোবিন্দাচার্যের ধারাবাহিক বিরোধিতাকে আমল না দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলে এন ডি এ-র সরকারি কার্যক্রম। সর্বশিক্ষা অভিযান, জাতীয় সড়ক নির্মাণে ব্যাপক সরকারি বিনিয়োগ, সবই তাঁর চিন্তাপ্রসূত।
আজকের বি জে পি-র সবচেয়ে বড় সমস্যা, এন ডি এ’কে নেতৃত্ব দিতে পারেন এমন কোনও মুখ সামনে নেই। নরেন্দ্র মোদী যতই সংঘ নেতৃত্ব ও গডকড়ীকে চাপ দিয়ে সংঘ প্রচারক অথচ মোদী-বিরোধী সঞ্জয় যোশীকে জাতীয় কর্মসমিতি থেকে পদত্যাগে বাধ্য করুন, তিনি যদি বি জে পি-র সর্বোচ্চ নেতৃত্বে উঠে আসেন, তবে অবশ্যই এন ডি এ-তে ভাঙন ধরবে। আবার সুষমা স্বরাজ বা অরুণ জেটলি যতই বলিয়েকইয়ে হোন, সংঘের অনুমোদন এখনও পাননি। ইয়েদুরাপ্পা বা মোদীকে সামলাতে ব্যর্থ গডকড়ী দ্বিতীয় বার সভাপতি হলেও তাঁর কোনও সার্বিক বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। আডবাণীর ব্লগই তার প্রমাণ। রাজনাথ হতাশ। আডবাণী ক্লান্ত।
এখন বি জে পি’কে অক্সিজেন জোগাতে পারে একমাত্র আর এস এস। সেটা পারে বি জে পি-র সঙ্গে নিজের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে। ১৯৮০-তে যে ‘দ্বৈত সদস্যপদ’-এর প্রশ্নে বি জে পি-র জন্ম, তা-ই আজ ফের প্রাসঙ্গিক। সংসদীয় রাজনীতিতে অভ্যস্ত একটি দল আপন কর্মসূচি ও নেতৃত্ব স্থির করুক। সে দলে অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যা থাকতেই পারে। কিন্তু তার নিরসন করতে হবে নির্বাচনে জনতার মুখোমুখি হওয়া নেতাদেরই। কোনও ধর্মীয় বা সামাজিক সংগঠন তা করতে পারে না। আডবাণী মাঝেসাঝে বিদ্রোহ করেন। কিন্তু ধারাবাহিকতা নেই। শুধু শ্যামাপ্রসাদের ছবি টাঙিয়ে রাখলেই হবে না, তাঁর স্বাধীন চিন্তাধারা ও কর্মকুশলতারও অনুসারী হতে হবে। তার প্রথম পদক্ষেপ স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ।
|
বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক |