সিকি শতক পেরিয়ে ফের মায়ানমারে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। ভারতের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থটি গুরুত্বপূর্ণ।
চিন তো আছেই। তা ছাড়া, মায়ানমার এখন উত্তর-পূর্বের জঙ্গিদের আশ্রয়। এবং,
অবশ্যই, আছে পূর্ব এশিয়ার দ্রুতগামী অর্থনীতি। লিখছেন
সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী |
সেই ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাজীব গাঁধী সে দেশে পা রেখেছিলেন। তার পরে নয়-নয় করে পঁচিশ বছর কেটে গেছে। এর মধ্যে আর কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মায়ানমার সফরে যাননি। কাজেই মে মাসের শেষ সপ্তাহটিতে মনমোহন সিংহের আমাদের পুবের এই পড়শি দেশে পদার্পণ তাৎপর্যপূর্ণ বই কী!
নরসিংহ রাও প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন এবং মনমোহন সিংহের অর্থমন্ত্রিত্বের সময়ে, ১৯৯০-এর দশকের গোড়ায়, নয়াদিল্লি ‘পুবে তাকাও নীতি’ ঘোষণা করে। আর্থিক ও নিরাপত্তার কৌশলগত দিক থেকে এই নীতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেই আমলে ঘোষিত ভারতের আর্থিক উদারীকরণ নীতির সঙ্গেও এর সামঞ্জস্য ছিল।
কিন্তু পুবে তাকাতে গেলে, বিশেষতপূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেন বাড়াতে গেলে যে দেশটির কথা না ভাবলেই ভারতের চলবে না, সেই মায়ানমারের সঙ্গে ইতিমধ্যে আমাদের সম্পর্ক অনেকটাই শীতল হয়ে পড়ে। রাজীব গাঁধীর সফরের অল্প পরেই মায়ানমারের তৎকালীন শাসক জেনারেল নে উইন’কে ক্ষমতাচ্যুত করে প্রশাসনের রাশ হাতে নেয় নতুন সামরিক গোষ্ঠী। দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি নস্যাৎ হয়ে যায়। ভোটে ন্যাশনাল লিগ ফর ডিমক্র্যাসি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও দলনেত্রী অং সাং সু চি’কে সরকার গঠন করতে দেননি সেনাকর্তারা। সেই থেকে লড়াকু, দৃঢ়প্রত্যয়ী অথচ ছোটখাটো চেহারার এই মহিলাকে দফায় দফায় জেলেই কাটাতে হয়েছে বেশির ভাগ সময়। না হলে গৃহবন্দি।
মায়ানমারের নতুন পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লির সঙ্গে রেঙ্গুন তথা ইয়াংগন-এর (তৎকালীন রাজধানী) দূরত্ব বেড়েছে। ওই পর্যায়ে সেনানায়কদের পরিবর্তে ভারতের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল সে দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের সঙ্গে। সু চি নোবেল শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত হওয়ার কিছু দিনের মধ্যে নয়াদিল্লি তাঁকে নেহরু শান্তি পুরস্কার দেওয়ার কথা জানায়। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে মায়ানমার সম্পর্কে ভারতের অবস্থান যথেষ্টই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
|
অথচ এই অবস্থান থেকে নয়াদিল্লিকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যেতে দেখা গেল মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে। মায়ানমারে গণতন্ত্র কোণঠাসা হওয়ার পর থেকে ভারত তথা পশ্চিমি দেশগুলির সঙ্গে সে দেশের সেনাশাসকদের দূরত্ব উত্তরোত্তর বাড়লেও চিন এই সময়ে মায়ানমারের অনেক ঘনিষ্ঠ হয়েছে। সেই সময়ে সব অর্থে একঘরে হয়ে পড়া ইয়াংগনের পাশে দাঁড়িয়েছিল বেজিং-ই। মায়ানমারের শাসকদের এই চিন-ঘনিষ্ঠতা স্বাভাবিক ভাবেই উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছিল ভারতীয় কূটনীতির কুশীলবদের। উপরন্তু, ভারতের সঙ্গে মায়ানমারের দূরত্বের ফসল তুলতে সক্রিয় হয়েছিল উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী। মায়ানমারের মাটিতে ঘাঁটি গাড়া ছাড়াও সে দেশের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের জন্য অস্ত্রশস্ত্র আমদানিও এই সময়ে নিয়মিত হয়ে দাঁড়ায়। এই পরিস্থিতি যদি ভারতের নীতি পুনর্বিবেচনার আশু কারণ হয়, তা হলে তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল পুবের দেশগুলির আপেক্ষিক আর্থিক সমৃদ্ধির হাতছানি।
এই বাধ্যবাধকতার নিরিখেই ১৯৯৭-এর ফেব্রুয়ারি মাসে বিতর্কিত ‘অপারেশন লিচ’-এর প্রেক্ষিতে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ এলাকায় একদল আরাকান-বিদ্রোহী ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে মারা যায়। মায়ানমারের সরকার-বিরোধী এই বিদ্রোহীদের সম্পর্কে আগাম খবর মিলেছিল ইয়াংগন থেকেই। অন্যান্য কারণ ছাড়া এই অভিযানের মাধ্যমে নয়াদিল্লি দুই দেশের মধ্যে ‘ছায়াযুদ্ধ’ বন্ধের বার্তা দিতে চেয়েছিল মায়ানমারের সেনাশাসকদের। কিন্তু ভারতের এই বদলে যাওয়া মত ও আচরণের প্রতিদানে মায়ানমারও ভারতীয় জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়া রদ করেছে এমন ইঙ্গিত আজও মেলেনি। বস্তুত, পরেশ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন আলোচনা-বিরোধী আলফা গোষ্ঠী বা মণিপুরের পি এল এ-এর গেরিলারা অনেকেই বর্তমানে চিন-মায়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় রয়েছে বলে ভারতীয় গোয়েন্দাদের দাবি। এর পাশাপাশি নাগা বিদ্রোহীদের একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে মায়ানমার সরকারের এই এপ্রিলের বোঝাপড়াও সাউথ ব্লকের কর্তাদের কপালে ভাঁজ ফেলেছে।
|
মিত্রতা। সু চি এবং মনমোহন সিংহ। মায়ানমার, ২০১২
|
অন্য দিকে, চিনের মায়ানমার-প্রীতি একাধিক কারণে। প্রথমত, দ্রুত আর্থিক বিকাশের যে পথ চিন এবং ভারত ইদানীং কালে বেছে নিয়েছে, সে পথে সাফল্যের চাবিকাঠি আছে জ্বালানির জোগানের মধ্যে। জ্বালানি নিরাপত্তা তাই আজ জাতীয় নিরাপত্তা কর্মসূচির অবিচ্ছেদ্য অংশ। নিকটবর্তী কোন এলাকায় তরল বা বাষ্পীভূত অঙ্গার পেট্রোলিয়ম ও প্রাকৃতিক গ্যাস মজুত রয়েছে, সেই দিকে তীক্ষ্ন নজর দুই এশীয় প্রতিবেশীরই। অতএব, মায়ানমারের ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক গ্যাসের দিকে দুই দেশেরই চোখ পড়েছে। ভারতের সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা এই গ্যাস উত্তোলনের ব্যাপারে সক্রিয় হলেও প্রথম দফায় চিন অনেকটাই এগিয়ে গেছে। যে এ-১ ব্লকে সবচেয়ে বেশি গ্যাস মজুত রয়েছে বলে অনুমান, সেই ব্লক থেকে গ্যাস আমদানি করবার অধিকার ইতিমধ্যেই বেজিংয়ের হস্তগত। তা ছাড়া, মায়ানমার থেকে চিনের ইউনান প্রদেশ পর্যন্ত প্রস্তাবিত পাইপলাইন তৈরি হলে মালাক্কা প্রণালী-বাহিত দীর্ঘতর পথ এড়িয়ে চিন নিজের জ্বালানির জোগানকে আরও সুনিশ্চিত, সহজতর ও কম ব্যয়বহুল করতে সক্ষম হবে। এ দিক থেকে ভারতের ঝুলি এখনও অনেকটাই খালি।
দ্বিতীয়ত, চিনের বাণিজ্যপথকে হ্রস্বতর করবার ক্ষেত্রেও মায়ানমারের ভৌগোলিক অবস্থান যথেষ্ট গুরুত্বের। তাই সে দেশে একাধিক বন্দর, সড়ক ও সেতু নির্মাণে বেজিং অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। বহুচর্চিত কালাদন প্রকল্পের বিষয়ে নয়াদিল্লি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি এখনও আশানুরূপ নয়। এই বহুমুখী প্রকল্পের অন্তর্গত জলপথ পরিবহণ ব্যবস্থা আগামী বছরের জুন মাস নাগাদ বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও সিতওয়ে বন্দর নির্মাণ ও সড়ক যোগাযোগের কাজ এখনও বেশ মন্থর। ইম্ফল-মান্দালয় বাস যোগাযোগও আপাতত অনিশ্চিত।
|
অতীতের প্রতিশ্রুত প্রকল্পগুলি ছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তি ও কৃষিবিজ্ঞানের মতো ক্ষেত্রে ভারত মায়ানমারকে সহায়তা দিতে পারে। এ বারের সফরে সেই মর্মে দুই দেশের মধ্যে চুক্তিও হয়েছে। সাড়ে ছয় কোটি মানুষের দেশটিকে আশি কোটি ডলার ঋণ দিতেও ভারত রাজি। বর্তমানে মণিপুর ও মিজোরামে সীমান্ত বাণিজ্যের যে দু’টি হাট চালু রয়েছে, সেই ধরনের হাটের সংখ্যাবৃদ্ধিও দুই দেশের বিবেচনাধীন। ভারত ও মায়ানমারের সীমানার দৈর্ঘ্য যেখানে ১৬৪৩ কিলোমিটার, সেখানে এই জাতীয় উদ্যোগ নিঃসন্দেহে দুই দেশের সংযোগসাধনে সহায়ক হবে।
নয়াদিল্লিকে পুবে তাকাতে গেলে উত্তর-পূর্ব ভারতীয় ভূখণ্ডকে বাদ দিয়ে তা সম্ভব নয়। সিতওয়ে বন্দর নির্মিত হলে তা মিজোরামের মাধ্যমে বাণিজ্যের পথকে আরও সুগম করবে। একই কারণে হলদিয়া বন্দরকেও উপেক্ষা করা অনুচিত। পুবে তাকাতে গেলে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গকে এড়িয়ে যাওয়া কার্যত অসম্ভব। সম্প্রতি কলকাতা সফরকালে মার্কিন বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিন্টনের এ ধরনের মন্তব্যের আগেই নয়াদিল্লির তা বোঝা উচিত ছিল। আয়তনে বৃহৎ দেশ চিন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে ইউনান প্রদেশকে ব্যবহার করে। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে গেলে নয়াদিল্লিরও পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতের সক্রিয় সমর্থন চাই। ভূগোলকে অস্বীকার করে আর্থ-রাজনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করা কঠিন। শুধুমাত্র নয়াদিল্লির সাপেক্ষে নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাপেক্ষেও বিদেশ নীতিকে দেখবার সময় এসেছে।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর এই তিন দিনের সফরে ২৬০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী শ্বেদাগন বৌদ্ধ বিহারেও যেমন গিয়েছিলেন, তেমনই শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের মাজারেও চাদর চড়িয়েছেন। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত অভিন্ন ব্রিটিশ উপনিবেশের অংশ হিসেবে থাকা এবং ইতিহাস ও সংস্কৃতির দিক থেকে সম্পর্কিত দুই দেশের মধ্যে নতুন করে সেতু নির্মাণ কঠিন নয়, কিন্তু সতর্কতা জরুরি।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, মার্কিন বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিন্টন বা রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব বান-কি মুন তাঁদের সাম্প্রতিক মায়ানমার সফরের সময়ে সু-চি’র বাসস্থানে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করলেও মনমোহন প্রোটোকল রক্ষা করে নিজের হোটেলেই এই নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। কূটনীতিতে ইঙ্গিত যথেষ্ট অর্থবহ। মনমোহনের এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে নয়া রাজধানী নেপিদ’তে রাষ্ট্রপতি উ থিয়েন সিয়েনকে আশ্বস্ত করেছে। তবে, দীর্ঘমেয়াদি স্তরে বিবেচনা করতে গেলে শুধু প্রতীকী অর্থে নয়, বৃহত্তর অর্থেই ভারতের মায়ানমার-নীতিকে পশ্চিমি দেশগুলির অনুরূপ নীতি থেকে আলাদা করতে হবে। নিজের পড়শিদের সঙ্গে সমীকরণ কী হবে, তা নিজেরই বোঝা প্রয়োজন। আর, কথা দিলে সেই কথা রাখতেও হবে।
|
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক |