বিশ্বজিৎ রায়ের ‘সন্তান = সম্পত্তি!’ (১৩-৫) প্রতিবেদন প্রসঙ্গে বলি, বৃদ্ধা মাকে ঠাকুরঘরে নির্বাসন দিয়ে, ঘরের আলো কেটে দিয়েও থেমে থাকেনি পুত্রসন্তান। বাড়ির দলিল নিজের নামে লেখানোর জন্য জন্মদাত্রীর গায়ে নিয়মিত হাত তোলে। তাতেও রাজি না-হওয়ায় অসহায় জননীকে গলা টিপে খুন করার চেষ্টা করে। দ্বিতীয় ঘটনা, মায়ের বাড়িতে থাকে, বাড়ির অংশ ভাড়া দিয়ে মাসে কয়েক হাজার টাকা রোজগারও করে। তবু ভরণপোষণ দূরের কথা, তাঁকে খেতেও দেয় না পুত্র। এ ধরনের বেদনাদায়ক ঘটনা বেশ কিছু দিন ধরেই আদালতের গোচরে এসেছে।
২০১১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী ভারতের ১১ কোটি নাগরিক বা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ ষাটোর্ধ্ব। এঁদের মধ্যে ৭০ শতাংশ বৃদ্ধা। ২০২৫ সালে আমাদের দেশে বয়স্ক নাগরিকের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ১৬ কোটি। ১৯০১ সালে ভারতে কোনও মানুষ যেখানে ৬৯ বছর বয়স অবধি বাঁচার আশা করতে পারতেন, বর্তমানে এক জন পুরুষ ৮০ এবং একজন মহিলা ৮২ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকতে সক্ষম। জাতীয় জনসংখ্যায় বার্ধক্যের আয়ুবৃদ্ধির এই অনুপাত পরিবারের উপর অতিরিক্ত ভরণপোষণের চাপ বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু সেই অনুপাতে কেন্দ্র-রাজ্য সরকারের কাছ থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সামাজিক সুরক্ষার জন্য বাড়তি কোনও আর্থিক অনুদান পাওয়া যায় না। পেনশনের সুবিধা ভোগ করেন এ দেশের মাত্র ১১ শতাংশ বয়স্ক নাগরিক। কিন্তু ২০০৪ সালের পর থেকে এই সামাজিক সুরক্ষায় ইতি টেনে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। |
বয়স্কদের নিরিখে দেশে শীর্ষস্থানে কেরল। দ্বিতীয় তামিলনাড়ু। পঞ্জাব, অন্ধ্রপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ যথাক্রমে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম। ভাবতে অবাক লাগে, কেরল সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ওই রাজ্যে যেখানে ১২৬টি সরকারি বৃদ্ধাশ্রম তৈরি হয়েছে এবং সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ৩০০টির বেশি বেসরকারি বৃদ্ধশ্রম গড়ে উঠেছেতা ছাড়াও বয়স্কদের পুনর্বাসনের জন্য একটি গোটা গ্রাম গড়ে তোলা হয়েছেসেখানে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা মাত্র একটি। বাদবাকি ৩৪টি বৃদ্ধাশ্রম নামমাত্র সরকারি অনুদানে কোনও রকমে টিমটিম করে টিকে আছে। অন্য দিকে, পশ্চিমী দুনিয়ায় গোটা মে মাস জুড়ে চলেছিল বয়স্ক নাগরিকদের জন্য হরেক অনুষ্ঠান। প্রসঙ্গত, কয়েক বছর আগে ফ্রান্সে বরিষ্ঠ নাগরিকদের জন্য বরাদ্দ পেনশনের কতিপয় সুবিধা বাতিল করা হলে গোটা দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তার ফলে সরকারকে তাদের আদেশ প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছিল। এ সব কারণেই কেন্দ্রের ইউ পি এ সরকার বেসরকারি ক্ষেত্রে পেনশনের সুবিধা বৃদ্ধির জন্য বরিষ্ঠ নাগরিকদের সামাজিক সুরক্ষার একটি প্রকল্প চালু করেছে।
২০০১ সালে কেন্দ্রের বাজপেয়ী সরকার ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর ওল্ডার পারসন’ নামক একটি সংস্থা তৈরি করলেও সুদীর্ঘ ১১ বছর বাদেও এ সংক্রান্ত কাজের কাজ এক চুলও এগোয়নি। পাশাপাশি, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন বামফ্রন্ট সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রক রাজ্যের প্রতিটি জেলায় একটি করে উন্নত মানের বরিষ্ঠাশ্রম নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিলেও আজও তা রূপায়িত হয়নি। আদালত পিতা-মাতার প্রতি অবশ্যকরণীয় কর্তব্য পালনে ছেলে-মেয়েদের আইনি বাধ্যবাধকতার কথা জোরালো কণ্ঠে উচ্চারণ করেছে। তার পরেই কেন্দ্রীয় সরকার পরিবারের বরিষ্ঠ সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ‘সিনিয়র সিটিজেনশিপ’ নামে একটি আইন প্রণয়ন করেছে। এতে বলা হয়েছে, পিতা-মাতার দেখভালের দায়িত্ব পুত্র-কন্যা পালন না-করলে তাঁদের কঠোর শাস্তি পেতে হবে। মাথার উপর আইনের দণ্ড থাকায় অবহেলা আর অবমাননার হাত থেকে অনেকাংশে মুক্তি পাবেন বরিষ্ঠ নাগরিকরা।
মানসকুমার রায়চৌধুরী। কলকাতা-২৬
|
বিশ্বজিৎ রায় যে প্রশ্নগুলি উত্থাপন করেছেন (১৩-৫) তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কয়েক বছর আগে ইনফোসিস সংস্থাটির কর্ণধার স্বনামখ্যাত নারায়ণমূর্তি মন্তব্য করেছিলেন যে, আমাদের সামাজিক বন্ধন তথা প্রকৃত দেশপ্রেমের অন্যতম কারণ ভারতীয়দের অত্যধিক পরিবারপ্রীতি। ভারতীয় তথা এশীয় সমাজগুলিতে পরিবারতন্ত্র তথা পিতৃতন্ত্রই প্রথম ও শেষ কথা। এশীয় সমাজগুলিতে প্রকৃত গণতন্ত্রের অভাবের (যার মধ্যে ‘ভারতীয় গণতন্ত্র’ নামক আদতে ভারতীয় oligarchy-টিও একটি উদাহরণ) মূল কারণ ভারতীয় তথা এশীয় সমাজগুলির ভিত ‘পরিবার’ নামক টোটালিটারিয়ান খুদে রাষ্ট্রের অগুনতি সমাহারে তৈরি একটা সমাজের মাটিতে। এই ‘পরিবার’ নামক সামন্ততান্ত্রিক সামাজিক কোষগুলির একচ্ছত্র অধিপতি কোনও ‘গুরুজন’ এবং তার গুরুত্বের একমাত্র মাপকাঠি বয়সের বলিরেখা অন্যথায় তিনি যতই অশ্রদ্ধেয় হন তাতে কিছু এসে যায় না।
সুখী সহাবস্থান ও শুভ পরিণতির মূল কথা, উদার মানসিকতা। এবং গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডল। একে অপরের বৈরী না-হয়ে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সম্মিলিত প্রয়াসে সুখের অন্বেষণ চলতে পারে। আমাদের প্রবীণ প্রজন্ম হয়তো তাদের পরবর্তী প্রজন্মের শুভাকাঙ্ক্ষী। অধিকাংশ বাবা-মাই সন্তানের মঙ্গল চান। কিন্তু সন্তানের কীসে ভাল হবে, তা বোঝার ক্ষমতা ক’জন বাঙালি বা ভারতীয় বাবা-মা’র থাকে? আইনস্টাইনের বাবা চেয়েছিলেন, ছেলে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার হোক। আইনস্টাইন পদার্থবিদ্যা পড়তে চাইলে তিনি অসুখী হয়েছিলেন, কিন্তু কোনও বাধা দেননি। ভারতেআরও বিশদ ভাবে বললে বাঙালি সমাজে বুদ্ধ ও মহাবীর থেকে শুরু করে নেতাজি, রবীন্দ্রনাথ, স্বামীজি, জাদুকর পি সি সরকার সবাই তাঁদের পরিবার বা বাবা-মা’র নির্দেশ অমান্য করে পথ বেছে নিয়েছিলেন। আমাদের সমাজে সবচেয়ে অবহেলিত children’s right অর্থাৎ ‘শিশুর অধিকার’, progeny’s right অর্থাৎ ‘সন্তানের অধিকার’ এবং nature’s right অর্থাৎ ‘প্রকৃতির অধিকার’। বিশ্বজিৎবাবু ‘পথের পাঁচালী’র সর্বজয়ার কথা বলেছেন। সর্বজয়া চেয়েছিলেন, অপুকে বিবাহবন্ধনে বেঁধে চালকলা-বাঁধা পুরোহিত তৈরি করতে। অপু মায়ের কথা অমান্য করেই কলকাতায় এসেছিল। এতে সর্বজয়ার একাকীত্ব রোধ করা যায়নি। কিন্তু গ্রামে পড়ে থাকলে আমরা লেখক অপূর্বকুমার রায়কে পেতাম না।
অনিন্দ্য সেনগুপ্ত। কলকাতা-১৯ |