কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদে কি আমজনতা সুরাহা থেকে বঞ্চিতই থাকবে! দিল্লির শাস্ত্রী ভবনে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের অলিন্দে এখন এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে।
পেট্রোলের উপর করের বোঝা কমিয়ে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের অনুরোধ জানিয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। মে মাসের শেষ সপ্তাহে পেট্রোলের দাম এক লাফে সাড়ে সাত টাকা বাড়ানোর পরে আবার দু’টাকা কমানো হয়েছে। রাজ্যগুলি কর কমালে, পেট্রোলের দাম আরও কমবে। কিন্তু রাজ্যগুলির দিক থেকে কতটা সাড়া মিলবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয়ে রয়েছেন পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের কর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, অতীতেও এমন অনুরোধে বিশেষ সাড়া মেলেনি। সম্প্রতি নানা বিষয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যগুলির ‘ক্ষমতার লড়াই’ শুরু হয়েছে। কেন্দ্র রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে চাইছে বলে বার বার অভিযোগ উঠেছে। এখন কেন্দ্র রাজ্যগুলিকে পেট্রোলের উপর কর কমাতে বলায় ফের সেই অভিযোগ উঠতে পারে। কর কমালেও কেন্দ্র সেই ক্ষতিপূরণ দেবে কি না, তা নিয়েও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে অর্থমন্ত্রীর অনুরোধে কতটা সাড়া মিলবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। মন্ত্রকের কর্তারা মনে করছেন, কেন্দ্রের সঙ্গে বিবাদের কথা ভুলে গিয়ে একমাত্র আমজনতার মন জয় করার জন্যই রাজ্যগুলি কর কমাতে পারে।
রাজ্যগুলির তরফে অতীতে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, কেন্দ্রের তুলনায় রাজ্যের আয়ের উৎস সীমিত। আয়ের একটা বড় অংশই আসে বিক্রয় কর থেকে। সেখান থেকে আয় কমলে উন্নয়ন খাতে খরচের অর্থও কমবে। এ বারও একই রকম যুক্তি আসবে ধরে নিয়ে পাল্টা যুক্তি তৈরি রাখছে কেন্দ্র। পেট্রোলিয়াম সচিব জি সি চতুর্বেদী বলেন, “পেট্রোলিয়াম ক্ষেত্র থেকে বছরে ১ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা কর বাবদ আয় হয়। যার মধ্যে অর্ধেক রাজ্যের কোষাগারে যায়। আবার রাজ্যগুলিকে কিন্তু পেট্রো-পণ্য বাবদ ভর্তুকির বোঝা বইতে হয় না। অথচ কেন্দ্র গত অর্থ বছরেই ৮৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে।” পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের হিসেব বলছে, প্রতি লিটার পেট্রোলে কেন্দ্র যে পরিমাণ কর আদায় করে, অনেক রাজ্যই তার থেকে অনেক বেশি কর আদায় করছে। উদাহরণ, প্রতি লিটার পেট্রোলে কেন্দ্রীয় করের পরিমাণ ১৪ টাকা ৭৮ পয়সা। অথচ পশ্চিমবঙ্গ সরকার তা থেকে বিক্রয় কর ও সেস বাবদ আয় করছে ১৬ টাকা ৫১ পয়সা। মহারাষ্ট্রে করের পরিমাণ আরও বেশি। পিছিয়ে নেই তামিলনাড়ুও। মুখ্যমন্ত্রীদের লেখা চিঠিতে এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করে প্রণববাবু রাজ্যের করের বোঝার চার ভাগের এক ভাগ কমানোর অনুরোধ জানিয়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
সেই অনুরোধে সাড়া দিলে, রাজ্যে পেট্রোলের দাম লিটারে প্রায় চার টাকা কমতে পারে। |
কলকাতায় পেট্রোলের দাম - ৭৫.৮১ টাকা |
তেল সংস্থার মূল্য - ৪৩.০২ টাকা |
ডিলারের কমিশন - ১.৫০ টাকা |
কেন্দ্রীয় কর - ১৪.৭৮ টাকা |
রাজ্যের কর - ১৬.৫১ টাকা |
|
পেট্রোলের দাম বাড়ার সঙ্গে রাজ্যের কর আদায়ের পরিমাণও বাড়ে। কারণ পেট্রোলের দামের উপর শতকরা হারে বিক্রয় কর বসায় রাজ্যগুলি। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেই পেট্রোলের দাম বাড়ার ফলে ১০০ কোটি টাকার কাছাকাছি বাড়তি আয় হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্য দিকে, ২০০৮ সাল থেকেই লিটার পিছু উৎপাদন শুল্ক বসায় কেন্দ্র। যার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে পেট্রোলের দাম বাড়াতে হলেও, করের পরিমাণ বাড়ে না। এর আগেও কেন্দ্রের তরফে একাধিক বার রাজ্যগুলিকে লিটার প্রতি নির্দিষ্ট হারে কর ব্যবস্থা চালু করতে বলা হয়েছিল। তাতে লাভ হয়নি। এ বারও মুখ্যমন্ত্রীদের লেখা চিঠিতে একই অনুরোধ জানিয়েছেন প্রণববাবু। কোনও কোনও মুখ্যমন্ত্রী উল্টে কেন্দ্রকে কর কমানোর কথা বলতে পারেন ধরে নিয়ে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রক যুক্তি দিচ্ছে, গত বছর অশোধিত তেলের উপর আমদানি শুল্ক কমিয়েছিল। এর ফলে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতির দায়ও কেন্দ্র নিয়েছে। এ বার মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যগুলির তরফে অভিযোগ এসেছে, প্রতিবার পেট্রোলের দাম ওঠানামার সঙ্গে বিক্রয় করের হার কমাতে-বাড়াতে হলে প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও নানা অসুবিধা দেখা দেয়। কেন্দ্রের যুক্তি, সেই জন্যই লিটার প্রতি নির্দিষ্ট হারে কর চাপাতে বলা হচ্ছে। এর ফলে দাম ওঠানামা করলেও কর ওঠানামা করবে না।
মে মাসের শেষে পেট্রোলের দাম বাড়ার পরেই কেরল, উত্তরাখণ্ড, দিল্লির মতো রাজ্যগুলি করের হার কমিয়েছে। অন্যান্য কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলিকেও কর কমানোর সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। কিন্তু পেট্রোলিয়াম মন্ত্রক মনে করছে, সব রাজ্য এক সঙ্গে কর না কমালে লাভ হবে না। কারণ পাশাপাশি দু’টি রাজ্যের মধ্যে পেট্রোলের দামের বিরাট ফারাক হয়ে গেলে, সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় কালোবাজারির সমস্যা তৈরি হতে পারে। |