মন্দার মারে বৃদ্ধির হার নিম্নগামী। সরকারের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে সমালোচনায় সরব হয়েছে শিল্পমহল, এমনকী শাসক দল কংগ্রেসের নেতারাও। এহেন পরিস্থিতিতে ‘সক্রিয়’ হলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ।
চলতি অর্থবর্ষে পরিকাঠামো প্রকল্প রূপায়ণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে আজ বৈঠক ডেকেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে তিনি বলেন, “সঙ্কটের এই প্রহরে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বাতাবরণ পুনরুজ্জীবিত করতে যথাসাধ্য করবে সরকার। এমন একটা পরিবেশ গড়তে হবে, যা লগ্নি-সহায়ক হওয়ার পাশাপাশি বৃদ্ধির পথে বাধা কাটাতে সাহায্য করবে।” প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, দেশকে আর্থিক বৃদ্ধির পথে ফেরাতে কী ধরনের বহুমুখী পদক্ষেপ করা দরকার তা সরকার জানে। আর তার সবই করা হবে।
গত অর্থবর্ষে আর্থিক বৃদ্ধির হার গত দু’দশকের মধ্যে সব থেকে নীচে নেমে আসার পর থেকেই মনমোহন সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা তীব্রতর হতে শুরু করেছে। গত কয়েক দিন ধরে শিল্প ও বণিক মহলের কর্তারা প্রকাশ্যে কেন্দ্রের নীতিপঙ্গু দশা ও স্তব্ধ হয়ে যাওয়া সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে কড়া ভাষায় মন্তব্য করছেন। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত বৈঠকেও সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীর সামনেই দলের বিভিন্ন রাজ্যের নেতারা জানিয়ে দেন, অর্থনৈতিক তত্ত্বের কচকচি আমজনতাকে বোঝানো সম্ভব নয়। অতএব সরকার অবিলম্বে কিছু একটা করুক। |
পরিকাঠামো নিয়ে বৈঠকে মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ার সঙ্গে মনমোহন সিংহ। ছবি: পিটিআই |
প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের দাবি, এমন পরিস্থিতিতে মনমোহন নিজেই হাল ধরতে নেমেছেন। তাঁর উদ্দেশ্য, তড়িঘড়ি শিল্পমহল ও গোটা বিশ্বের কাছে ইতিবাচক বার্তা পৌঁছে দেওয়া। সে জন্য সুনির্দিষ্ট কতগুলি ব্যবস্থা নিতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী। এক, পেনশন বিলে অনুমোদন দিয়ে পেনশন ফান্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের দরজা খুলে দেওয়া। দুই, বিমান পরিষেবায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির অনুমোদন দেওয়া। তিন, সরকারি ও বেসরকারি পরিকাঠামো প্রকল্পগুলির কাজ ত্বরান্বিত করা। আর্থিক সংস্কারের পথে এই সব পদক্ষেপ করা গেলে শিল্পমহলের আস্থা ফিরে পাওয়া যাবে বলেই আশাবাদী সরকারের একটা বড় অংশ।
বস্তুত, সরকারের এই ‘তৎপরতা’ যে ইতিমধ্যেই বাজারে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে, তার ইঙ্গিত স্পষ্ট। আজই মুম্বই শেয়ার বাজারের সূচক সেনসেক্স ৪৩৪ পয়েন্ট বেড়েছে। যা চলতি বছরে এক দিনে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি। বেড়েছে পরিকাঠামো ক্ষেত্রের বহু সংস্থার শেয়ার দরও। পাশাপাশি ডলারের তুলনায় টাকার দরও আজ ২৮ পয়সা বেড়েছে।
আজ সন্ধ্যায় তাঁর বাসভবনে ডাকা বৈঠকের শেষে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “দ্রুত আর্থিক বৃদ্ধির সঙ্গে পরিকাঠামো খাতে উন্নয়নের বিষয়টি যে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, তা সকলেই জানেন। এবং সরকারও এখন সেটাই করতে চাইছে। কেননা পরিকাঠামো ক্ষেত্রে উন্নতি যেমন স্বল্পমেয়াদে আরও বেশি বিনিয়োগ টানতে সাহায্য করবে, তেমনই দীর্ঘমেয়াদে শিল্প-বাণিজ্যের সহায়ক হবে।”
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, এ দেশে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিনিয়োগের বিপুল চাহিদা রয়েছে। দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী যোজনায় পরিকাঠামো ক্ষেত্রে এক লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ দরকার। সরকারের একার পক্ষে এত অর্থ বিনিয়োগ সম্ভব নয়। তাই বেসরকারি বিনিয়োগ জরুরি। এ কথা বলেই মনমোহন জানান, চলতি অর্থবর্ষে ৯৫০০ কিলোমিটার নতুন রাস্তা তৈরি হবে। সেই সঙ্গে চার হাজার কিলোমিটার রাস্তা মেরামত করা হবে। তা ছাড়া পণ্য করিডর, দু’টি রেল কারখানা ও কয়েকটি রেল স্টেশন সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে করার লক্ষ্য রয়েছে। সেই সঙ্গে নতুন বিমানবন্দর, বন্দর ও ১৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রকল্প গড়া হবে।
আজকের বৈঠকে শুধু কেন্দ্রের পরিকাঠামো সংক্রান্ত মন্ত্রকের মন্ত্রী ও সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের কর্তারা ছিলেন। কিন্তু তাঁদের সামনেও প্রধানমন্ত্রী লিখিত বক্তৃতা পাঠ করেন। যা পরে বিবৃতির আকারে প্রকাশ করা হয়। কংগ্রেস সূত্রের বক্তব্য এর কারণটা স্পষ্ট। মনমোহন সরকারের অন্দরে যত না বার্তা দিতে চেয়েছেন, তার চেয়ে বেশি দিতে চেয়েছেন শিল্প ও বণিক মহলকে এবং গোটা দেশকে।
তবে বিজেপি ও বিরোধীদের অভিযোগ, এ সবই লোক দেখানো। আসলে সংস্কার হচ্ছে হবে করেই দিন কাটাচ্ছে সরকার। বিজেপি মুখপাত্র প্রকাশ জাভড়েকরের কথায়, “প্রধানমন্ত্রীর মাঝে মাঝেই ইচ্ছা হয় সংস্কারের কথা বলতে। কিন্তু তিনিও জানেন, তাঁর শরিকরাই তা হতে দেবে না।”
আর শিল্পমহলের অনেকের মতে, অতীতে বহু বার এ ধরনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু পরিকাঠামো ক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান সমস্যাই সরকার এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তা হল জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতা। তা ছাড়া, পরিবেশের ছাড়পত্র-সহ নানা জটিলতা রয়েছে। সরকার যদি সে সব বাধা কাটানোর ব্যবস্থা করে, তবেই কাজের কাজ হতে পারে। |