এ যেন হার্ডল রেস! একটা বাধা টপকানোর পরে সাময়িক স্বস্তি। পরক্ষণেই আরও একটা বাধা সামনে চলে আসছে। দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে মাধ্যমিক, তারপর উচ্চ মাধ্যমিকে সফল হয়েও তাই স্বস্তিতে নেই ওঁরা।
রসায়ন নিয়ে গবেষণা করার ইচ্ছা নানুরের পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা সুদীপ মণ্ডলের। চণ্ডীদাস স্মৃতি বিদ্যালয় থেকে এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনি বিজ্ঞান বিভাগে ৪১৫ নম্বর পেয়েছেন। কিন্তু পরিচিতজনদের কাছ থেকে এতদিন বই চেয়ে এনে পড়াশোনা করা সুদীপের স্বপ্ন পূরণ হবে কি না তা নিয়ে ওঁর পরিবারের লোকেরা দুঃশ্চিন্তায় রয়েছেন। তাঁর বাবা ভবসিন্ধু মণ্ডল স্থানীয় মুদির দোকানে কাজ করে সামান্য রোজগার করেন। স্বামীর সেই আয়ে দুই ছেলের পড়ার খরচ সামলে সংসার চালাতে হিমশিম খান স্ত্রী শিখাদেবী। তিনি বলেন, “ছেলের এই সাফল্যে খুশি হলেও মনে উদ্বেগ জাগছে। ওর উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন সফল হবে কি করে, জানি না।” সুদীপ বলেন, “স্বপ্ন ছিল গবেষণা করে কিছু আবিষ্কার করব। কিন্তু এখন পড়াশোনাই চালিয়ে যেতে পারব কিনা তা জানি না।”
আট বছর আগে স্বামীর মৃত্যুর মতো ফের এখন অসহায় হয়ে পড়েছেন নানুরের মেলেপাড়ার রীতা কর্মকার। কারণ তাঁর ছেলে বিপত্তারণ কর্মকার কীর্ণাহার শিবচন্দ্র হাইস্কুল থেকে এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে কলা বিভাগে ৪২৭ নম্বর পেয়েছেন। স্বামীর মৃত্যুর পরে ঘটি-বাটি বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন রীতাদেবী। |
মুড়ি ভেজে কোনওরকমে সংসার চালান। কিন্তু কারখানায় ভাজা মুড়ির চল বেড়ে যাওয়ায় ঘরে মুড়ি ভাজার ডাক কম আসছে। তাই এখন তাঁর সম্বল বলতে শুধু খড়ের ছাউনির মাটির ঘর। কিন্তু ছেলের শখ, ইংরেজি নিয়ে পড়াশোনা করে শিক্ষক হবে। সংসারের হাল ফেরাবে। তাই আক্ষেপ রীতাদেবীর গলায়, “উচ্চশিক্ষার খরচ তো অনেক! ছেলের সেই সাধ মেটাব কী করে?” একই চিন্তায় আকূল বিপত্তারণও। বইপত্র কেনা, কলেজে যাতায়াতের খরচও ঢের। তাঁর সংশয়, “মাধ্যমিকে ভাল ফল করেও টাকার অভাবেই বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে পারিনি। টাকার অভাবেই বোধহয় এ বার পড়াশোনা ছাড়তে হবে।”
একই রকম আশঙ্কার দোলাচলে রয়েছেন রাজনগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে ৪৩৫ নম্বর পাওয়া রাজনগর বড়বাজারের সূপর্ণা নন্দন। তাঁর ইচ্ছা ভূগোলে অনার্স পড়বে সিউড়ি কিম্বা দুবরাজপুরের হেতমপুর কলেজে। কিন্তু বাধ সেধেছে সেই দারিদ্র। তাঁর বাবা স্বপন নন্দন এক সময় ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। এখন দৃষ্টি শক্তি কমে আসায় তিনি কার্যত বসে গিয়েছেন। সূপর্ণার দাদা লটারির টিকিট বিক্রি করে যা টাকা পান, তাতেই ওদের সংসার চলে। স্বপনবাবু বলেন, “মেয়েটার পড়াশোনা কীভাবে হবে জানিনা।” সূপর্ণা বলেন, “মাধ্যমিকের পরে স্কুলের শিক্ষক থেকে পড়শি সকলেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁদের সম্মানও রেখেছি।” এ বারও তেমন কিছুই ঘটুক, চাইছেন স্বপ্ন দেখা মেয়েটি। |