‘সন্তান চাই না’ নারীর মুখে এ কথা শুনলেই সমাজ শিউরে ওঠে। এখনও। লিখছেন
বোলান গঙ্গোপাধ্যায়
|
গত ৫ মে আনন্দবাজার পত্রিকার ভিতরের পাতায় ছোট একটি সংবাদে চোখ আটকে গেল। মুম্বই হাইকোর্ট বছর তিরিশ বয়সের রমেশ শিনয়ের বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা খারিজ করে দিয়েছে। তার আগে, পারিবারিক আদালতেও তাঁর আবেদন খারিজ হয়ে গেছে। স্ত্রী প্রীতির বিরুদ্ধে রমেশের অভিযোগ, প্রীতি সন্তান ধারণ করতে চান না। গর্ভনিরোধক ব্যবহার না করে স্বামী-সহবাসে রাজি হন না। এটা বিবাহ-বিচ্ছেদের কোনও কারণ হতে পারে না বলে মুম্বই হাইকোর্ট মনে করে।
খবরটি পড়তে পড়তে অনেকগুলি মেয়ের মুখ একসঙ্গে মনে পড়ল। তাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে আমার কথা হয়েছে। এঁদের সকলেই নিরক্ষর, বহুপ্রসবিনী এবং বাল্যবিবাহিতা। অনেকেই প্রথম ঋতুদর্শনের পরই সন্তানসম্ভবা হয়েছেন। যেমন চাঁদ বিবি। মুর্শিদাবাদের টেঁয়া গ্রামে চাঁদ বিবির বাড়ি। তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল সালারে, তাঁর ছেলের শ্বশুরবাড়িতে। চাঁদ বিবি সেখানে এসেছিলেন পুত্রবধূ মর্জিনা বিবির গর্ভনিরোধের পাকাপাকি ব্যবস্থা করতে। তাঁর স্বামী এবং পুত্র রাজি হবেন না, তাই চাঁদ বিবি পুত্রবধূর বাপের বাড়ি থেকেই ব্যবস্থা করতে চান। নিজে আটটি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। পাঁচটি বেঁচে আছে। পুত্রবধূ মর্জিনাও তিনটি সন্তানের মা। চাঁদ বিবি যা কথা বলেছিলেন, তার সারমর্ম এই রকম: তিনি নিজে অবাঞ্ছিত সন্তান কী করে আটকাতে হয়, জানতেন না। তাই কিছু করতে পারেননি। কিন্তু পুত্রবধূর বেলায় এই ভুল তিনি করতে দেবেন না। মর্জিনার রোগা-ভোগা চেহারা দেখিয়ে বলেছিলেন, কেউ বলবে ওর বয়স পঁচিশ? এই রকম বছর-বিয়োনি হয়ে কেউ বাঁচতে পারে? মর্জিনা নিজেও চাননি আর সন্তান। কিন্তু স্বামীকে সে কথা বলবার সাহস তাঁর নেই। তাই চাঁদ বিবি এগিয়ে এসেছেন হাল ধরতে। মর্জিনার পিতৃগৃহের লোকেরা যে এই সিদ্ধান্তে খুশি, এমন নয়। কিন্তু চাঁদ বিবির কথার উপর কথা বলতে পারেন না তাঁরা। |
পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে-গ্রামে চাঁদ বিবিদের দেখা পাওয়া সহজ নয়। কিন্তু তাঁরা আছেন এবং কেউ কেউ মাথাও তুলছেন। উত্তর চব্বিশ পরগনার গ্রামে শিখা মাঝি নামে একটি অল্পবয়সি বধূ আমায় বলেছিলেন, ‘শাড়িই সামলাতে পারতাম না, তখন ছেলে কোলে এল!’ সন্তান চাই কি চাই না, এ প্রশ্ন মেয়েদের কেউ করে না। ধরেই নেওয়া হয়, বহুপ্রসবিনী হওয়ার মধ্যেই নারীজীবনের চরম সার্থকতা লুকিয়ে আছে। কোনও মেয়ে যদি সে সার্থকতা না চান, তা হলেই মনে করা হয়, তাঁর অন্য কোনও মতলব আছে।
শহরের চাকরি-করা শিক্ষিত মেয়েরা এখন অনেকটাই এই শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়েছেন, সন্দেহ নেই। একটি মেয়েকে জানি, যে পরিষ্কার করেই বলেছিল, ‘আমি আমার কাজের জগতে সবচেয়ে উঁচুতে পৌঁছতে চাই। সেই কেরিয়ার তৈরি করতে গেলে সন্তানকে সময় দেওয়া সম্ভব নয়। আমি সন্তান চাই না।’ এর পর অবশ্য তার নিন্দায় চেনাশোনা অনেককেই মুখর হতে দেখেছিলাম।
আমাদের দেশের অধিকাংশ মেয়ে চিন্তা-বলয়ের মধ্যেই ‘সন্তান যে না চাওয়াও যেতে পারে’, সেই সম্ভাবনাই নেই। এটাই বাস্তব। এখন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাস্তবের চাপ আর শিক্ষার প্রভাবে মেয়েরা সচেতন হয়ে উঠছেন। বুঝতে পারছেন, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হওয়া ছাড়াও নারীজীবন সার্থক হতে পারে। কিন্তু সমাজের চাপে এই ভাবনাও অনেক সময়ই আলোর মুখ দেখে না। এখনও ‘বন্ধ্যাত্ব’র চেয়ে বড় অভিশাপ মেয়েদের জীবনে হয় না।
আদালত রমেশ শিনয়ের আর্জি খারিজ করলেই সমাজ বদলে যাবে, এমন নয়। কিন্তু আদালতের ‘ভাবনা’ সমাজে প্রভাব ফেলে, সেটা অস্বীকার করা যায় না। আদালত এক প্রকারে মেয়েদের ‘না’ বলার অধিকারকে স্বীকৃতি দিল। প্রীতির মতো মেয়েদের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সেই অধিকারকে সমাজও এক দিন স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হবে, এটুকুই আশা। |