প্রবন্ধ ১...
পাড়ার চেয়েও লোকাল

হাড় জিরজিরে শরীর, পেটে আট মাসের সন্তান, সঙ্গে আরও কয়েকটি খুদে, তাদেরও প্রতিটি হাড় গোনা যায় সেই জ্বালিয়ে ওরা বেঁচে থাকার রসদ জোগাচ্ছে অবশিষ্ট কিছু শ্বাসে। আর ‘মাস’? শরীর থেকে অবলুপ্ত। ওই অপূর্ব কম্পোজিশনের ছবিটি হেঁটে চলেছে ২২ দিন ধরে। পেটে দানা নেই। বাচ্চারা আর মা বাইশ দিন ধরে শুধু জল খেয়ে, পেটে গিঁট বেঁধে চলেছে কোনও রিলিফ ক্যাম্পে যদি একটু খাবার মেলে, যদি এ বারটা বেঁচে যাওয়া যায়। যখন খিদের তাড়নায়, জীবনের তাড়নায় এই মা বেরিয়ে পড়েছিল বাড়ি থেকে, তখন খুদের দলে আরও এক জন ছিল। মা তাকে রাস্তার এক ধারে শুইয়ে রেখে এগিয়ে গিয়েছে। ‘এই তো আসছি বাবা, এইখানে তুমি একটু শুয়ে নাও, আমি খাবার নিয়ে ফিরব’ আর পিছে ফিরে তাকায়নি মা। দু’দিন বা এক দিন বা চার ঘন্টা, মানে যতটুকু সময় লেগেছে ছোট্ট মানুষটার প্রাণটা একেবারে শেষ হতে, ততক্ষণ সময় ও পরম বিশ্বাসে মা’কে খুঁজেছে, মা’র ফিরে আসার প্রতীক্ষা করেছে। কিন্তু মা ফেরেনি। আরও দুটোকে হারাতে না হয় এই ভয়ে মা পেট টেনে, পা টেনে রিলিফ ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে চলছে। একটু খাবার, একটু জল, একটু ওষুধ দাও না গো। আমার দুটো বাচ্চা মরে গিয়েছে। আর তিনটে কি বাঁচতে পারে না? আর এখুনি রাস্তার ধারে যে জন্ম নিল, তার কী হবে? ওই বাচ্চাটা জন্ম নেওয়ার পর যে আরও খিদে পাচ্ছে গো...
দেশটার নাম সোমালিয়া। যেখানে দুর্ভিক্ষ হয়ে থাকে ঘটমান বর্তমান গত কুড়ি বছর ধরে। ১৯৯১ থেকে দেশটায় ঠিকঠাক কোনও সরকার নেই, নানান এলাকায় শাসন করে গোলা-বন্দুক সমৃদ্ধ নানান গোষ্ঠী। দেশের মানুষ তাদের মধ্যে উত্তম স্যান্ডউইচ হতে থাকে। ফলে উন্নয়ন না, বিনিয়োগ না, এমনকী সাহায্যও মেলে না বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন সংস্থার হাত ধরে। যারা সাহায্য করতে চায়, তাদের পথ আটকায় উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো। আল-কায়দার অন্যতম শক্তিশালী শাখা আল-শাবাব এখন সোমালিয়ার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মানুষের ভাগ্যনিয়ন্তা। তারা ‘ফরেন এড’ ঢুকতে দেয় না। তারা দেশের মানুষকে পালিয়ে বাঁচতেও দেয় না। তারা জানে কেবল ক্ষমতা। তাতে মানুষ মরল, তো? অবশ্য, তারা শিশুদের চাকরি দেয় যোদ্ধা করে তোলে। উত্তরাধিকার সূত্রে দিয়ে দেয় হিংসা আর নির্মমতা।
আর অনাহার। গত বছর যা চরমে উঠেছে। সোমালিয়ায় গত বছর ভয়ঙ্কর খরায় এত লোক মারা গিয়েছে উপোসে আর অসুখে, যে দেশের ছ’টি জেলায় রাষ্ট্রপুঞ্জ দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করেছে। পূর্ব আফ্রিকায় গত ষাট বছরে এমন খরা হয়নি। চিপ্পে-নিংড়ে যাওয়া মানুষগুলোও এত মোচড় খায়নি, ওদের হাড়গুলো এতটা ক্ষয়ে যায়নি, হৃৎপিণ্ডের লাফানোর ক্ষমতা হয়তো আর একটু বেশি ছিল, মায়ের বুক নিংড়োলে দু-চার ফোঁটা দুধ হয়তো বেরোত এ বার খরা শুষে নিয়েছে সব। ভাঁড়ার ঢনঢন। এ বছর বৃষ্টি হয়েছে, রাষ্ট্রপুঞ্জ গত ফেব্রুয়ারিতে ঘোষণা করেছে দুর্ভিক্ষ শেষ। কিন্তু অন্তত কুড়ি লাখ লোক এখনও বিপন্ন, জরুরি উদ্যোগে তাদের কাছে খাবার পৌঁছে না দিতে পারলে আরও বহু মৃত্যু আটকানো যাবে না। পাইকারি মৃত্যু।
এ বার সত্যি বলুন, বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করছে না? চোখের কোণ জ্বালা জ্বালা করছে না? অথচ আমরা ক’জন ঠিক জানি সোমালিয়ার এমন ভয়ঙ্কর অবস্থার কথা? এত বড় মন্বন্তর পৃথিবীর ইতিহাসে কম হয়েছে, এত মানুষ মারা গিয়েছে যে তাদের হিসেব রাখা মুশকিল হয়ে পড়ছে। আমরা জানিও না।
আগে কিন্তু জানতাম আমরা। দুনিয়ার কোথায় মানুষ অনাহারে আর মহামারিতে আর যুদ্ধে মরছে, খোঁজ রাখতাম। কলকাতার দেওয়াল জুড়ে লেখা হয়েছিল ‘তোমার নাম, আমার নাম, ভিয়েতনাম’। মন জুড়েও। সে কেবল আমেরিকা অন্যায় করছে বলে তো নয়, ভিয়েতনামের মানুষগুলোর মৃত্যু আর সর্বনাশ আমাদের মনকে নাড়া দিত, নাপাম বোমার আগুনে ঝলসে যাওয়া নগ্ন মেয়েটির বাঁচার চেষ্টায় আপ্রাণ দৌড়ের ছবি রাতের ঘুম কেড়ে নিত। এ সব তথ্য জানার জন্য তখন কেবল ভরসা ছিল খবরের কাগজ, আর রেডিয়োর কয়েক লাইন সংবাদ। অথচ একটা মধ্যবিত্ত কেরানি, একটা মুটে, একটা রিকশাওয়ালা, একটা কলেজ ছাত্রী, একটা গৃহবধূ, আবার একটা ব্যবসাদারও জানত দুনিয়ার মার-খাওয়া মানুষদের কথা।
আসলে তখন অনেক মানুষের জানানোর তাগিদ ছিল। আর জানারও তাগিদ ছিল। আন্তর্জাতিকতা কথার কথা ছিল না, ভিয়েতনামের কথা, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের ছাত্র আন্দোলনের কথা অনেকেই জেনেছিল পাড়ার মোড়ে মোড়ে পথসভা থেকে। ম্যারাপ খাটিয়ে ভয়ঙ্কর সব ছবি দেখিয়ে এক দল বলেছিল, দেখ, যা হচ্ছে, তা অন্যায়, তা ভাল হচ্ছে না। অফিস-ফেরতা অনেক মানুষই কিন্তু ম্যারাপ খাটানো শালুর তলায় দাঁড়িয়ে দেখতেন পৃথিবীর কোথায় কী ঘটে গেল। হ্যাঁ, পঁয়ত্রিশ হাজার লোকের বয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পঁয়ত্রিশ জনের সহমর্মিতা পেয়েছিল এই ছবিগুলো আর ছবিতে থাকা ওই লোকগুলো। তাঁরা তাঁদের মন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিলেন সেই সব হেরে যাওয়া, পিষে যাওয়া, নিংড়ে যাওয়া মানুষের সারিতে।
এখুনি সবাই হইহই করে বলবেন, নিজের ঘরের কাছে কী হচ্ছে তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই, সারা পৃথিবীর চিন্তায় তেনার ঘুম হচ্ছে না ন্যাকাহ্! কিন্তু যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথা সবাই জেনেছিল, তার আগে-পরে খাদ্য আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছিল কিছু লোক, এক পয়সা ট্রাম ভাড়া কমানোর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিল, তারও অনেক আগে মন্বন্তরের সময় মানুষকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। যার অন্যের প্রতি দরদ থাকবে, তার গণ্ডির বিচার থাকবে না। সে পাশের বাড়ির লোকের কথাও ভাববে আবার সোমালিয়ার লোকের কথাও ভাববে।
অথচ এখন আমাদের এ সব খবর জানার জন্য পথসভার প্রয়োজন নেই, লিফলেট বিলির দরকার নেই, কৌটো ঝাঁকানোর প্রয়োজন নেই, ম্যারাপের তলায় ছবি দেখার দরকার নেই। আমরা টেক-স্যাভি প্রাণীরা পটাপট জেনে ফেলছি আধুনিকতার বর্ণপরিচয়, ইন্টারনেট থেকে, যা বিশ্বায়নের দান।
কিন্তু কী জানছি? আমরা জানছি হলিউড অভিনেতা অ্যাশটন কুচার কী ভাবে ভারতীয়দের উপহাস করে অ্যাড করেছে, আমরা উদ্গ্রীব হয়ে সার্চ করেছি কবে অভিষেক-ঐশ্বর্যা তাদের মেয়ের নাম জানাবে, আমরা ফেসবুকে আপডেট পোস্ট করেছি ‘কেন বৃষ্টি হচ্ছে না কলকাতায়, আমি এত ডাকছি যে!’ আমরা এক মিনিটের এমএমএস-এ দেখে নিচ্ছি উন্মুক্ত মেয়ের বুকের কাপ-সাইজ কত, এমনকী আমরা লাইভ-রেপও দেখে ফেলছি। কিন্তু আমরা উত্তর কোরিয়ার প্রিজন ক্যাম্পে নিংড়ে যাওয়া মানুষের কথা জানছি না, আমরা জানছি না দক্ষিণ সুদান একটা দেশ তৈরি হওয়ার পর কেন নয়ছয় হয়ে যাচ্ছে, আমরা জানছি না কঙ্গোয় এত ধর্ষণ হচ্ছে যে সেই সংখ্যাটা সুইস ব্যাঙ্কের টাকার সমান হয়ে যাচ্ছে, কুড়ি বছর ধরে ইথিয়োপিয়া বা সোমালিয়ার মানুষরা যে না খেতে পেয়ে তিলে তিলে মরে যাচ্ছে সেই সব কথা আমরা মোটেও জানার চেষ্টা করছি না।
হ্যাঁ, যখন একটা কালোকোলো মানুষের ছবি, তার বেরিয়ে আসা হাড়, তার ঠিকরোনো চোখ আন্তর্জাতিক ফোটোগ্রাফির কোনও পুরস্কার পাচ্ছে, তখন আমরা বলছি ওয়াও!!! প্লিজ শেয়ার, ফেসবুকে লাখ লাখ শেয়ার। তা হলে? এই যে ওই ছবিটার মধ্যে দিয়ে বয়ে এল সোমালিয়ার মানুষের কথা, সেটা কি কম? কিন্তু অন্য বিনোদনের উপকরণ এত এত যে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের বেশি এই মানুষগুলোর কথা আমাদের মনে দাগ কাটে না। আমরা মেতে উঠি উন্নততর বিনোদনে। আমরা এখানকার পথশিশুর কথাও ভাবি না, সোমালিয়ার অভুক্ত শিশুর কথাও ভাবি না। পাতের বাড়তি ভাত অবলীলায় ফেলে দেওয়ার আগে ক’জন একটা অভুক্ত বাচ্চাকে খুঁজি, সোমালিয়ার একটা বাচ্চার কথা ভেবে? আমরা ধরেই নিয়েছি ও সব এন জি ও-রা করবে। আমাদের বিবেকের বোঝা ওরা না হয় খানিক বেশিই বইল।
যখন এমন টোয়েন্টি ফোর বাই সেভেন বিশ্বায়ন ছিল না, তখন আমরা আন্তর্জাতিক খবর, দুনিয়ার লোকজনের কষ্ট, ভ্রাতৃত্ববোধ অনেক বেশি করে জেনেছি, বুঝেছি, কষ্ট পেয়েছি। এখন আমরা যত প্রসারিত হতে পেরেছি তত নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছি। নিজের স্বার্থপরতাবাদকে স্মার্টনেস এবং বুদ্ধিমত্তা বলে র্যাশনালাইজ করেছি। কোনও কিছুর প্রতি দায় বোধ করিনি, করি না এবং নিজেদের যতটুকু চিনি তাতে ভবিষ্যতেও আশা করি করব না। যদিও দাবি করব আমরা বিশ্ব-নাগরিক, কিন্তু আসলে আমরা পাড়ার চেয়েও লোকাল।
এর পরেও মাঝে মধ্যেই আমাদের চেতনে ইলেকট্রিক কারেন্ট দেবে কিছু ঘটনার ঘনঘটা। আমরা থেকে থেকে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে উঠব, কখনও কিছু না জেনে অ্যান্টি-কোরাপশন আন্দোলনে যোগ দেব, কখনও জেগে উঠে জেসিকা লাল-এর জন্য ছিনিয়ে আনব জাস্টিস। কখনও-সখনও। ইতিমধ্যে ওই যে সোমালিয়ার মা’টি, সে আরও বাইশ দিন হাঁটবে, আরও দু-একটা বাচ্চাকে পথের পাশে ফেলে চলে যাবে, কখনও রাগের চোটে মাটি খুঁড়ে কাঁউকাঁউ খাবে বসুন্ধরা, কখনও নিজের স্তন উপড়ে সন্তানকে দুধ দেওয়ার চেষ্টা করবে। আমরা জানতেও পারব না ও রকম আরও কত জন পথিমধ্যে হারিয়ে যাবে। যদি জনাকয় বাঁচে, তা হলে ইন্টারনেটে নিশ্চয়ই খবর হবে। আর আমরা ‘লাইক’ করব।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.