এ বার সরাসরি মুসলিমদের জন্য সংরক্ষণের দাবি তুলিয়া দিল তৃণমূল কংগ্রেস। দলের সংখ্যালঘু নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুলতান আহমেদ দাবি তুলিয়াছেন অথবা তাঁকে দিয়া দাবিটি তোলানো হইয়াছে, হয়তো এই লক্ষ্যে, যাহাতে পরে বিপাকে পড়িলে বলা যায় দলের নির্বাচনী ইস্তাহারে তো এমন দাবি নাই। সংরক্ষণের এই দাবির আগে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী দুইটি স্বতন্ত্র ঘোষণায় ইমামদের মাসিক ভাতা এবং মুয়েজ্জিনদের মাসোহারা দিবার সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিয়াছেন। এই গোটা কর্মসূচিরই অভিমুখ ধর্মের ভিত্তিতে কোনও বিশেষ সম্প্রদায়কে কিছু পাওয়াইয়া দেওয়ার। সংবিধানে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক অনুগ্রহ বিতরণ অবাঞ্ছিত অথবা সরাসরি নিষিদ্ধ। সংরক্ষণ কিংবা অনুগ্রহ বিলির একমাত্র স্বীকৃত ভিত্তি সেখানে সামাজিক অনগ্রসরতা, আর্থিক পশ্চাৎপদতাও যাহার একটি অঙ্গ হিসাবে গণ্য হইতে পারে, ধর্মীয় পরিচয় নয়। কিন্তু তাহাতে সুলতান আহমেদ কিংবা তাঁহার নেত্রীকে দমানো যায় নাই। পঞ্চায়েত নির্বাচনে ২৬ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট বাক্সবন্দি করিতে বোধ করি যে কোনও পন্থাপদ্ধতিই শিরোধার্য।
ভারতে মুসলিমদের অনগ্রসরতা একটি সামাজিক বাস্তব। সেই অনগ্রসরতা ঘুচাইতে শিক্ষা ও চাকুরিতে বিশেষ সুবিধা দানের যুক্তি আছে, হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে আংশিক সংরক্ষণেরও। কিন্তু ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক পরিচয় নয়, আর্থিক বা সামাজিক অনগ্রসরতাই সেই সংরক্ষণের ন্যায্য ভিত্তি। মুসলিম বলিয়াই যদি কেহ সরকারের কাছে কোনও বিশেষ সুবিধা দাবি করেন, তবে তাহা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সিংহদুয়ার উন্মোচিত করিবে। মুসলিম ইমাম ও মুয়েজ্জিনদের মাসোহারার সিদ্ধান্ত যেমন হিন্দু পুরোহিত, খ্রিস্টান পাদ্রি এবং শিখ গ্রন্থীদের অনুরূপ সরকারি অর্থানুকূল্যের দাবির ক্ষেত্র প্রস্তুত করিয়াছে। শুধু তাহাই নহে, ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণ চালু করিলে সম্পন্ন, শিক্ষিত, ধনাঢ্য মুসলিমরাই কিন্তু অনগ্রসর মুসলিমদের প্রাপ্য সুযোগসুবিধাগুলি হস্তগত করিয়া লইবেন, যেমন তফসিলি জাতি-জনজাতি ও অনগ্রসর শ্রেণির জন্য চালু করা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ইতিপূর্বে ঘটিয়াছে। পাইকারি হারে সংরক্ষণ যে ঐতিহাসিক ভাবে অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ শ্রেণিগুলিকে টানিয়া তোলার বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি নয়, ইহা প্রমাণিত। ইহা কেবল ভোটের বাজারে রাজনৈতিক দলকে তাৎক্ষণিক কিছু সুবিধা দিতে পারে, দিয়া থাকে।
সুলতান আহমেদ কিংবা তাঁহার নেত্রীও নির্বাচনী লাভের বাহিরে কোনও প্রকৃত, সুসংহত সংখ্যালঘু উন্নয়নের কথা ভাবিতেছেন, এমন মনে করার কারণ নাই। ভাবিলে তাঁহারা ওয়াকফ সম্পত্তি লইয়া চলিয়া আসা দুর্নীতির উদ্ঘাটনে ব্রতী হইতেন। এই বিষয়ে যে কোনও সরকারই কখনও সচেষ্ট হয় নাই, তাহাতেই বুঝা যায়, শাসকদের সহিত সর্বদা সংখ্যালঘু সমাজপতিদের ‘অপবিত্র যোগসাজশ’ থাকে। সংখ্যালঘুর কল্যাণের কথা ভাবিলে শাসকরা সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত এলাকায় স্কুল-কলেজ-পাঠাগার গড়ার কর্মসূচি লইতেন, থানা-ফাঁড়িতে সংখ্যালঘু কনস্টেবল নিয়োগ করিতেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতাল গড়িতেন। শিক্ষার যে বিপুল আগ্রহ পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুদের মধ্যে জাগিয়াছে, সুস্বাস্থ্য ও সুচিকিৎসা প্রাপ্তির জন্য যে আকুতি সৃষ্টি হইয়াছে, কর্মসংস্থানের যে দাবি মুখর হইতেছে, মাদ্রাসা খুলিয়া, ইমাম-মুয়েজ্জিনদের মাসোহারা দিয়া তাহা পূরণ হওয়ার নয়। সুলতান আহমেদ আবার মুসলিমদের স্বতন্ত্র আবাসনের জন্যও জমি খুঁজিতেছেন। হিন্দু মুসলমানের সহাবস্থানের পরিবর্তে পৃথক আবাসনের সরকারি আয়োজন? ইহাই তবে তৃণমূল কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষতার যথার্থ অভিজ্ঞান? ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ভারতের বিস্তর ক্ষতি করিয়াছে। কেবল বর্তমান ভারতের নয়, ব্রিটিশ ভারতেরও। শেষ পর্যন্ত দেশ দ্বিভাজিত হইয়াছে। কিন্তু দেশভাগে সেই ক্ষতি শেষ হয় নাই, স্বাধীনতার পরেও ধর্মাশ্রিত রাজনীতির বলি হইয়াছেন বহু মানুষ, লাঞ্ছিত হইয়াছে ভারতের সমাজ ও অর্থনীতি। এখনও আগুন লইয়া খেলা? |