পশ্চিমবঙ্গে রাজধর্ম ফিরিতেছে? প্রশ্নচিহ্নটি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, রাজ্যে তৃণমূল-কংগ্রেস জোট সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তির পালা চলিতেছে। সেই সময় রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলীয় কর্মীদের কিছু নির্দেশ দিয়াছেন। তিনি তৃণমূল কংগ্রেস-এর সর্বময় নেত্রী। তাঁহার নির্দেশগুলি তাৎপর্যপূর্ণ। এই অর্থে অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ যে, ইহার অভিঘাত নিছকই সংশ্লিষ্ট দলীয় স্তরে সীমাবদ্ধ নহে। বৃহত্তর প্রশাসনিক প্রেক্ষিতেও গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাস বলিতেছে, বিগত এক বৎসর ধরিয়া প্রশাসনিক পরিসরে বারংবার দলীয় ছায়া আসিয়া পড়িয়াছে। অনভিপ্রেত ছায়া। এই ব্যাধি অপরিচিত নহে। বামফ্রন্ট জমানায় দলীয় প্রতাপ অজস্র ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ন্যায়কে আচ্ছন্ন করিয়াছে। রাজধর্মের উপর গুরুত্ব পাইয়াছে দলীয় স্বার্থ। প্রশ্ন ছিল, ‘পরিবর্তন’-এর পরে সেই রাজ-ব্যাধির প্রকোপ কমিবে তো? যথেষ্ট ভরসার কারণ এখনও পাওয়া যায় নাই। বিশেষ করিয়া শিক্ষাক্ষেত্রে দলীয় প্রতাপ নানা ভাবে ছায়া ফেলিয়াছে। পতাকার রং বদলাইয়াছে, পতাকা যায় নাই। রবীন দেব গিয়াছেন, আরাবুল ইসলাম আসিয়াছেন। এই পরিস্থিতিতে দলীয় সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বার্তা আসিল। সেই বার্তা পরিস্থিতির একটি গুণগত পরিবর্তনের সম্ভাবনাকেই সূচিত করে। ইহা আশার কথা। অভিনন্দনের যোগ্যও বটে।
মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল প্রতিনিধিদের দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কিছু নিষেধাজ্ঞার কথা শুনাইয়াছেন। থানা বা ব্লক উন্নয়ন দফতর বা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইচ্ছা মাফিক ঢুকিয়া পড়িবার বিষয়ে কড়া সতর্কবার্তা উচ্চারিত হইয়াছে। জন-স্তর এবং প্রশাসনিক স্তরে দলীয় প্রতাপে হুকুমদারি চলিবে না। ইহাই রাজধর্মের একটি মৌলিক শর্ত। ভারতের প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রশাসনিক ক্ষমতা বিশেষ কোনও দল বা জোটের হস্তে থাকিতেই পারে। তাহা কিন্তু কোনও ভাবেই প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে সেই দল বা জোটের বেআইনি আধিপত্যকে সমর্থন করে না। কারণ, প্রশাসনিক ক্ষমতায় আসিবার পরে শাসক বিশেষ কোনও দলের বা জোটের আওতাভুক্ত নহেন। তিনি সমগ্র রাজ্যবাসীরই ভাল ও মন্দ দেখিবার জন্য শপথবদ্ধ। সুতরাং, প্রশাসনিক স্তরে যদি দলীয় ছায়া পড়ে, দলীয় প্রতাপের ভয়ে প্রশাসন যদি কোনও অন্যায়ের প্রতিকার করিতে অপারগ হয়, বা শিথিলতা দেখায়, তাহা কর্তব্যচ্যুতির শামিল। রাজধর্ম সেই চ্যুতিকে সমর্থন করে না।
তর্ক উঠে, পূর্বে কেহ কেহ এই ধরনের অন্যায় করিয়াছিলেন। কিন্তু, পূর্বে কোনও ব্যক্তি বা দল এই জাতীয় অপকর্ম করিয়াছিলেন বলিয়া সেই একই অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি করিতে হইবে, ইহা বদলার রাজনীতি হইতে পারে, প্রশাসনিক ধর্ম নহে। দলীয় প্রতিনিধিদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ সেই প্রশাসনিক ধর্মকেই তুলিয়া ধরিবার কথা বলিয়াছে। আশা করা যায়, দুইটি স্তরে ইহার প্রভাব পড়িবে। এক, প্রতিনিধিগণ দলীয় নেত্রীর নির্দেশ স্মরণে রাখিবেন। ফলে, দলীয় স্বার্থে প্রশাসনকে ব্যবহার করিবার প্রবণতাটি দূর হইবে। দুই, প্রশাসনও মুখ্যমন্ত্রীর বার্তার নিহিতার্থ অনুধাবন করিবে, ফলে রাজধর্ম অনুযায়ী যে স্থানে যে রূপে তৎপর হওয়া প্রয়োজন, তাহার কোনও ব্যত্যয় ঘটিবে না। রাজধর্মের বিকৃতির কিছু নমুনা তৃণমূল কংগ্রেস-এর নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রথম বৎসরে দৃশ্যমান হইয়াছে। তাহা রোধ করা দরকার। অবিলম্বে। |