স্ত্রীর প্রয়োজনে বেনারস যেতে হয়। অতীতে সপরিবার ভারতের বহু স্থানে এবং কলকাতার বিভিন্ন ভ্রমণ সংস্থার মাধ্যমে সেকেন্ড ক্লাস থ্রি টিয়ার স্লিপারে ভ্রমণ করেছি গত বছর পর্যন্ত। দেখেছি, দশ-বারো বছর আগেও রেলের যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল, তা ক্রমে ক্রমে শিথিল হতে হতে বর্তমানে ভেঙে পড়েছে। সেকেন্ড ক্লাস রিজার্ভড নন-এসি থ্রি টিয়ার্স কামরায় ৭২ জন বৈধ যাত্রীর সঙ্গে অতিরিক্ত ৭২ জন কিংবা আরও বেশি যাত্রীর ঠাসাঠাসি অবস্থা কেবলমাত্র দিনেই নয়, রাতেও। প্যাসেজে, কামরার দু’দিকের দরজা ও বেসিনের কাছে যাত্রীর সঙ্গে বস্তাবন্দি মাল এবং অন্যান্য কৌশলের যাত্রাও দেখেছি। শুনেছি, আড়াই-তিন গুণ বেশি ভাড়া এসি কামরার সিটের। সুতরাং আশা ছিল, এসি কামরা নিশ্চয়ই হরি ঘোষের গোয়াল হবে না।
মেয়েও সঙ্গে যাবে এবং উত্তর ভারতে। সে কারণে বাতে পঙ্গু, প্রায় হ্যান্ডিক্যাপড ৬২ বছরের মা এবং ই এন টি রোগী ও অ্যাক্সিডেন্টে বুকের হাড় ভাঙা ৭০ বছরের বাবার সুবিধার কথা ভেবে সে এসি কামরার টিকিট কাটে। ট্রেন নং-১৩০০৯, হাওড়া-দুন এক্সপ্রেস, ৫ এপ্রিল ২০১২, রাত ৮-৩৫ মিনিটে যাত্রায় কিছু বিনা টিকিটের কিংবা বিনা সংরক্ষণের যাত্রী থাকলেও আমরা নিরুপদ্রবেই পৌঁছলাম।
কিন্তু ফিরতি যাত্রা হল মহা ভয়ঙ্কর। ৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ট্রেন নং-১৩০০৬/অমৃতসর-হাওড়া মেল, ট্রেন ছাড়ার সময় ৪-৫৫ (বেনারস টাইম)। বেনারসে ট্রেন পৌঁছল বিকাল ৪-৪০ মিনিটে। এসি বি-২ কামরা, সিট-৪৪ (এল বি), ৪৫ (এম বি), এবং ৪৮ (এস ইউ)। |
নির্দিষ্ট কামরার নির্দিষ্ট সিটে পৌঁছে দেখলাম, এক ভিখারিনি প্রায় ১-৫ বছর বয়সের তিনটি ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে ৪৪ নং সিটে আরামে বসে আছে, কিছুতেই উঠতে চায় না। সামনের ৪১, ৪২, ৪৩ নং আপাতত খালি ছিল। তবে ৪১-এ কম্বল ভাঁজ করা ও বেডশিট পাতা ছিল। আমরা ধমক দিয়ে তাকে ৪১ নং সিটে বসতে বলতেই ওই সিটের কলকাতাগামী বৈধ যাত্রী হাজির হলেন। ভিখারিনি অন্যত্র উঠে গেল। আমাদের সঙ্গে মাল বলতে কাঁধে ঝোলানো তিনটি ব্যাগ। ৪১, ৪৪ নং সিটের এবং সাইডে যে কাঠের প্লেট যাত্রীর খাওয়ার জন্য, যেটি সে দিন ৪৭ নং সিটের যুবকদের সারা রাত মোবাইলের ব্যাটারি চার্জ দেওয়ার জন্যই ব্যবহৃত হয়েছিল। তার নীচেও বড় চেন লাগানো ব্যাগ ও সুটকেসে ঠাসা ছিল। সাইডে নীচের ৪৭ নং সিটে ৪-৫ জন যুবক বসে ছিল। তাদের দু-একটা ব্যাগ, অন্ততপক্ষে কাঠের প্লেটের নীচের চেন বাঁধা বড় ব্যাগটি সরিয়ে নিতে বলতেই তারা জানাল, ব্যাগ সরানো হবে না।
এদের মদতদাতা ৪১ নং সিটের কলকাতাগামী (ভাষাসূত্রে দেশোয়ালি ভাই) ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, প্রবলেম কেয়া? স্ত্রীকে দেখিয়ে জানালাম, ইনি পা রাখার জায়গা কোনও রকম পাচ্ছেন না। ৪১ নং বলল, মালের উপরেই পা রাখুন। তাকে বোঝালাম, ওঁর হাঁটুতে ‘নি-ক্যাপ’ বাঁধা, হাঁটু ভাঁজ করতে পারবেন না। ৪১ নং জানালেন, ‘সবাইকে তো যেতে হবে, কোঅপারেশন সকলকেই করতে হবে।’ মেয়ে নিয়মকানুন, ভদ্রতা, শিষ্টাচারের কথা একটু বলতেই আমি ধমক দিয়ে চুপ করে যেতে বললাম। কারণ, আমি জানি, চুপ না-করার ফল মারাত্মক হতে পারে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বোঝা গেল, সম্ভবত সাইডের ৪৭ নং সিট আর এ সি, এবং দু’জনে পৃথক স্থানের যাত্রী হলেও ভাষাসূত্রে দেশোয়ালি ভাই। তারা ৬-৭ জন যুবক আরা থেকে চিত্তরঞ্জনের যাত্রী। ৪৭ ছাড়াও তাদের আরও দু-একটি আর এ সি থাকলেও মালপত্রগুলি আমাদের খুপরিতে জমা করেছে। এরা যেখানেই ফাঁকা সিট পেয়েছে সেখানেই বসেছে এবং কামরায় উঠে ট্রেনের তথা কামরার টি সি-কে টাকা দিয়ে ছাড়পত্র পেয়েছে। ট্রেনের টিটিদের সঙ্গে এদের দহরম-মহরম দেখে মনে হল, এরা টিটি-দের পোষ্যপুত্র কিংবা কামধেনু। এরা যত বেশি ওঠে, তত বেশি টাকা রেলের ফান্ড না হলেও টিটি-দের পকেট ফান্ড স্ফীত করে। এদের ভাষা, ভঙ্গি, ব্যবহার ভদ্র তো নয়ই, পরন্তু উগ্র। মেয়ে প্রথমে একটু তর্কাতর্কি করেছিল, কিছুক্ষণের মধ্যেই পরোক্ষে মেয়েকে একটু ধমকাতে তাদের কথাবার্তায় উঠে এল, রেলের সর্বত্রই কর্মচারী, টিটি, পুলিশ, মিলিটারিতে তাদের লোক আছে। তারা যা খুশি করতে পারে। কেউ কিছু করতে পারবে না। এরা একপাক্ষিক ফায়ার করে গেল। কারণ, অন্য পক্ষ আমরা নিরুত্তর।
এদের আসল খেলা শুরু হল, মোগলসরাইয়ের পর। পিসবোর্ড কিংবা ট্রেনের লম্বা গোলাকার জিনিস একে একে বার হতে লাগল। ৪৭ নং সিটের এবং আমাদের পর্দাও ফেলে দিল। শুরু হল পান পর্ব। এক হিন্দিভাষী যাত্রীর ভাষায়, ‘শরাব পান করছে’। আমি খুবই শঙ্কিত হলাম। ৪৪ নং স্ত্রীকে এবং ৪৫ নং মেয়েকে দিয়ে আমার পক্ষে ওঠা কষ্টকর হওয়া সত্ত্বেও আমি সাইড আপার ৪৮ নং সিটে উঠলাম। তিন জনে কেউ-ই সারা রাত ঘুমালাম না। মুড়ি-মশলা, কাঁচা পেঁয়াজ, সুগন্ধী পানমশলা খেলেই কি মদের গন্ধ চাপা দেওয়া যায়? এক জন আসে, এক জন যায়। কয়েক ঘণ্টা ৪৭ নং সিটে ও প্যাসেজে জটলা। কত বার টিসি এবং রেল পুলিশরা সেই জটলা ঠেলে যাতায়াত করল, কেউ টুঁ শব্দটি করল না। এরা যা খুশি তাই করতে লাগল। আমাদের খুপরির পর্দার ভিতরে সিলিং ফ্যান। মাঝে মাঝে পর্দা তোলে এবং ফ্যান চালায়। অথচ রাতের আবহাওয়া মোটেও গরম ছিল না। তা ছাড়া এসি কামরার শৈত্য তো ছিলই। সময় যায়, আর মেয়ের উপর রাগ বাড়ে। কেন মরতে সে এসি টিকিট কাটল! জানি, বিপদে কেউ এগিয়ে আসবে না। তা হলেও নন এসি সেকেন্ড ক্লাস থ্রি টিয়ার স্লিপারে প্রকাশ্যে প্রায় দুশো চোখের সামনে কোনও দুষ্কর্ম করা সহজসাধ্য নয়।
কিছুক্ষণ পরে তাদের মধ্যে একে অন্যের ব্যাগ খোলা এবং মোবাইল ও ক্যামেরা চুরি করা নিয়ে তর্কাতর্কি, পরে ঝগড়া শুরু হল। হাতাহাতি হয় হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হল না। আরা স্টেশন থেকে এক জন করে নামে, আর একটি করে সুটকেস বা বড় ব্যাগ কমতে থাকে। চিত্তরঞ্জনের পর আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম। বিশ্বেশ্বর বিশ্বেশ্বরীর কৃপায় আমাদের অন্য কোনও বিপদ হল না সত্যি, কিন্তু দেখলাম, এসি কামরায় ভ্রমণও নিরাপদ বা নিরুপদ্রব নয়। এ কামরায় অসংরক্ষিত ও বিনা টিকিটের যাত্রীদের যাতায়াতের অবাধ সুযোগ আছে। বাথরুমের পাশে বেসিন ও দু’পাশের দরজার কাছে কম হলেও যাত্রী ও মাল ছিল।
বুঝলাম, ট্রেনের ভাড়া বাড়ছে ও বাড়বে। তার সঙ্গত কারণও আছে। কিন্তু যাত্রী পরিষেবা দেওয়ার ক্ষমতা তথা বহু টাকা খরচ করে টিকিট কাটা বৈধ যাত্রীদের নিরাপদে, নিরুপদ্রবে যাতায়াতের সুযোগ করে দেওয়ার প্রশাসনিক ক্ষমতা ও দক্ষতা ভারতীয় রেলের নেই।
চণ্ডীসাধন কোলে। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, কানানদী, হুগলি
|
রেল কর্তৃপক্ষ মহিলা ও প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে ই এম ইউ ট্রেনে পৃথক কামরা এবং আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু প্রবীণ পুরুষ নাগরিকদের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ উদাসীন। রাজ্যের ট্রাম-বাসগুলিতে বয়স্ক নাগরিকদের জন্য পৃথক আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। যদি ই এম ইউ ট্রেনগুলিতে বয়স্ক নাগরিকদের জন্য পৃথক আসন সংরক্ষণ করা যায়, সেটাই হবে জীবনের প্রান্তিক সময়ে পৌঁছানো বয়স্ক নাগরিকদের প্রতি রেল কর্তৃপক্ষের যথাযথ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। ভিড়ে ঠাসা ট্রেনগুলিতে যখন ষাটোর্ধ্ব প্রবীণদের হাঁসফাঁস করতে দেখি, তখন এক জন নাগরিক হিসাবে নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। তাঁদের প্রতি সমাজের কি কোনও দায় নেই?
বিমলকুমার দাস। সম্পাদক, চুঁচুড়া রেলওয়ে প্যাসেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশন |