‘জোর করে’ সংযুক্তিই সমস্যা, অভিযোগ কর্মীদের |
যাঁদের মধ্যে সদ্ভাব নেই, দেখা হলেই চুলোচুলি, তাঁদের জোর করে একই পরিবারের মধ্যে রেখে দিলে যা যা হওয়ার, এয়ার ইন্ডিয়ার ক্ষেত্রে ঠিক তাই ঘটে চলেছে বলে মনে করছেন সংস্থারই অনেকে। অভিযোগ, এক রকম জোর করেই ২০০৭ সালে মিশিয়ে দেওয়া হয় সাবেক ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স এবং এয়ার ইন্ডিয়াকে। এবং সমস্যার শুরু সেখান থেকেই। লাভ হবে বলে দুই সংস্থাকে মিশিয়ে দেওয়ার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, দেখা যাচ্ছে, তাতে আরও বেশি ক্ষতি হচ্ছে সংস্থার। তাই দুই সংস্থাকে আবার পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় কি না, তা নিয়ে এ বার চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে বলে বিমান মন্ত্রক সূত্রের খবর।
অভিযোগ, দুই সংস্থার সব স্তরের কর্মী-অফিসারেরাই একে অন্যের উপরে খড়্গহস্ত। সম্প্রতি এয়ার ইন্ডিয়ার পাইলটদের ধর্মঘটও তারই বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করছেন অনেকে। দুই যুযুধান পক্ষের মত অনুযায়ী, মাথার উপরে অভিভাবক হিসেবে পরিণত মস্তিষ্ক, দূরদর্শী কেউ থাকলে মিলেমিশে থাকার সম্ভাবনা কিছুটা হলেও ছিল। কিন্তু বিমান মন্ত্রক এবং এয়ার ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষ সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ বলেই সংস্থার কর্মী-অফিসারদের মত। সংস্থার মাথায় বিমান পরিবহণের সঙ্গে যুক্ত কোনও অভিজ্ঞ ব্যক্তি বা বিশেষজ্ঞকে না রেখে আইএএস অফিসারদের বসিয়েও কেন্দ্র ভুল করছে বলে অভিযোগ দুই সংস্থার কর্মীদের। যদিও অনেকেই মনে করেন, প্রশাসনিক কাজে অভিজ্ঞ বলেই আইএএস-দের সংস্থার মাথায় বসানো হয়েছিল। আইএএসের হাতে পড়েই বহু রুগ্ণ সংস্থা লাভের মুখ দেখেছে। ফলে কর্মীদের এই বক্তব্য একেবারেই ঠিক নয়।
দুই সংস্থাকে মিশিয়ে দেওয়ার পর থেকে একাধিক ধর্মঘট-কর্মবিরতি-বিক্ষোভে জর্জরিত এয়ার ইন্ডিয়া। যার প্রায় পুরোটাই, “ওরা পেলে আমরা কেন পাব না”, বা “আমাদের সঙ্গে ওদের কিছুটা তফাৎ রাখা দরকার”, গোছের অভিযোগ-বক্তব্যের কারণে। কর্মীদের সামলাতে না পেরে চারটি ইউনিয়নের স্বীকৃতি বাতিল করেছেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাতেও এয়ার ইন্ডিয়ার ‘ব্র্যান্ড নেম’-এর যে ক্ষতি হচ্ছে, তা সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। জাতীয় বিমানসংস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন যাত্রীরা।
মিশিয়ে দেওয়ার আগে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স চলত দেশের অভ্যন্তরে। বিদেশের কয়েকটি ছোট রুটেও তাদের উড়ান চলত। এয়ার ইন্ডিয়া চলত শুধু বিদেশে। জেট, কিংফিশারের মতো বেসরকারি সংস্থা উড়ান চালাতে শুরু করায় একাধিপত্য হারায় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স। ডেকান এসে সস্তায় টিকিট দিতে শুরু করায় আরও সমস্যায় পড়ে যায় তারা। ২০০৭ সালে দুই সংস্থা মিশিয়ে নাম দেওয়া হয় এয়ার ইন্ডিয়া। বিমানের সংখ্যা বেড়ে যায়। উদ্দেশ্য ছিল, সবচেয়ে বড় সংস্থা হিসেবে বিমান পরিবহনের বাজার দখল করা। শেয়ার ছেড়ে বাজার থেকে টাকা তোলার চেষ্টা হলেও সে ভাবে টাকা ওঠেনি। উল্টে প্রতি বছর লোকসানের বহর বেড়েছে। এখন দুই সংস্থার দুই পাইলট একই সুরে অভিযোগ করে বলছেন, “তখন দেখাই হল না এই সংযুক্তির ফলে কী ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। আমরা কী চাই, তা ডেকে জানতে চাওয়া হল না।”
দু’পক্ষই বলছেন, তাঁরা এক সঙ্গে থাকতে চান না। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের এক সিনিয়র পাইলটের যুক্তি, “কেন থাকব? সবাই এক ছাতার তলায় থাকলে তো একই সুবিধা, একই মর্যাদা পাওয়ার কথা। আমাদের চেয়ে এখনও ওদের বেতন বেশি! (ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের পাইলট মাসে গড়ে চার লক্ষ টাকা করে পেলে এয়ার ইন্ডিয়ার পাইলট পান প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকা।) আমরা আন্তর্জাতিক উড়ানে বছরে এক বার এবং অভ্যন্তরীণ উড়ানে বছরে পাঁচ বার বিনা পয়সার টিকিট পাই। ওঁরা যত বার খুশি বিনা পয়সায় যাতায়াত করতে পারেন!” অভিযোগ, এ রকম বিভেদ শুধু পাইলটদের মধ্যেই নয়, অন্য কর্মী-অফিসারদের মধ্যেও রয়েছে। সাবেক ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের এক অফিসারের কথায়, “প্রতিটি মূহূর্তে আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে, সংস্থায় ওঁরা প্রথম শ্রেণি আর আমরা দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মী!”
বিদেশে লম্বা রুটে যাঁরা বিমান চালান, এয়ার ইন্ডিয়ার এমন এক পাইলটের কথায়, “দূরপাল্লার উড়ান চালালে ক্লান্তি আসে। নিয়মিত সেই কাজ করা বেশ কষ্টের। তাই, আমাদের কিছু ভাতা অন্যদের তুলনায় বেশি। আমাদের যাঁরা কো-পাইলট হিসেবে চাকরিতে আসেন, তাঁদের পদোন্নতি হতে ৯ বছর লেগে যায়। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের কো-পাইলটেরা ৩ বছরেই কম্যান্ডার হয়ে যান। ফলে, ওঁরাও কিছু সবিধা তো পান।” সংস্থার চূড়ান্ত অর্থসঙ্কটের মধ্যেও মাথাপিছু প্রায় এক কোটি টাকারও বেশি খরচ করে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের পাইলটদের কেন দূরপাল্লার বোয়িং ৭৮৭ ‘ড্রিমলাইনার’-এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। এয়ার ইন্ডিয়ার পাইলটের কথায়, “নিয়মিত বোয়িং চালান না বলে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের পাইলটদের বোয়িং-এ প্রশিক্ষণ দিতে অর্থ ও সময় দুই-ই বেশি লাগবে। জেদ করে ওদের কেন ওই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে?” |