অনিল বসুকে নিয়ে বেজায় টানাপোড়েনে পড়েছেন সিপিএম শীর্ষ নেতৃত্ব। তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সিপিএমের পলিটব্যুরো। উল্টো দিকে দলের অস্বস্তি বাড়িয়ে অনিলবাবু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আগামী মাসে দিল্লিতে কৃষকসভার সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক কমিটির বৈঠকে তিনি যোগ দেবেন। দল থেকে সাসপেন্ড করা হলেও গণসংগঠনের বৈঠকে যোগ দিতে তাঁর বাধা নেই।
দল থেকে সাসপেন্ড হওয়ার পর অনিলবাবু যে ভাবে রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন, তার পরে তাঁকে বহিষ্কার করার মতো চরম ব্যবস্থা নেওয়াটাই নীতিগত ভাবে ঠিক সিদ্ধান্ত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, সংগঠনের আয়তনের থেকে গুণগত মানের দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে দলে। কিন্তু নীতিগত অবস্থানের সঙ্গে বাস্তব অবস্থানের বিস্তর ফারাক। সিপিএমের পলিটব্যুরোর নেতারা বুঝতে পারছেন, পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দল এখন ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে। পুরনো মুখ সরিয়ে নবীন, স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতাদের দলের মুখ হিসেবে তুলে ধরারও চেষ্টা চলছে। কিন্তু এটাও সত্যি যে অনিল বসু, সুশান্ত ঘোষ বা লক্ষণ শেঠের মতো নেতাদেরই গত ৩৪ বছর ধরে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এখন তাঁদের বিরুদ্ধে হঠাৎ করে ব্যবস্থা নিতে গেলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। তা ছাড়া, জেলায় জেলায় এঁদের হাতেই এখনও দলের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এঁদের তাড়াতে গেলে ‘মুণ্ডু গেলে খাবটা কী’ গোছের দশা হবে কি না, উঠতে পারে সেই প্রশ্নও।
আপাতত তাই ‘ধীরে চলো’ নীতিই নিতে চাইছে সিপিএম। আজ দিল্লিতে পলিটব্যুরো বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকের ফাঁকে প্রশ্ন করা হলে অনিলবাবু সম্পর্কে নির্দিষ্ট জবাব দিতে চাননি রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু। তাঁর বক্তব্য, “সংবাদমাধ্যমের বানানো গল্পের কোনও উত্তর দেব না। সংবাদমাধ্যমের খোরাক হব না।” প্রশ্ন উঠেছে, অনিলবাবু নিজেই সস্ত্রীক সাংবাদিক বৈঠক করে রাজ্য সম্পাদকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করার হুমকি দিয়েছেন। বিমানের জবাব, “সাংবাদিকদের যেমন প্রশ্ন করার অধিকার রয়েছে, আমারও উত্তর না দেওয়ার অধিকার রয়েছে।” এতে দু’টি বিষয় বেশ স্পষ্ট, অনিল প্রশ্নে প্রকাশ্যে বিতর্ক এড়িয়ে চলতে চাইছে দল। |
দুই, তাঁর ব্যাপারে কোনও তাড়াহুড়ো না করাটাই শ্রেয় মনে করছেন সিপিএম নেতৃত্ব। কারণ, অনিলবাবুকে সাসপেন্ড করা হয়েছে তিন মাসের জন্য। এই তিন মাসে তাঁর আচরণ দলের পক্ষে সন্তোষজনক মনে হলে, ‘সাসপেনশন’ প্রত্যাহারের পথ খোলা রয়েছে। তা ছাড়া, অনিলবাবু এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র বিমানের বিরুদ্ধেই মুখ খুলেছেন। এখনও সেই অর্থে গোটা দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেননি। বেশি কঠোর হতে গেলে তিনি হিন্দমোটর কারখানার জমি বিতর্ক নিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, নিরুপম সেনদেরও নিশানা করতে পারেন। আখেরে তাতে দলেরই ক্ষতি হবে।
অনিলবাবু অবশ্য এখনও তেমন ইঙ্গিত দেননি। বরং তিনি জানিয়েছেন, আগামী ১১ ও ১২ জুন দিল্লিতে কৃষকসভার কেন্দ্রীয় কৃষক কমিটির বৈঠকে যোগ দেবেন। ওই কমিটির তিনিও সদস্য। সেখানে কৃষকসভার পরবর্তী কর্মসূচি তৈরি হবে। এস আর পিল্লাই, কে বরদারাজনের মতো পলিটব্যুরো সদস্য, মদন ঘোষ, হান্নান মোল্লার মতো কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারাও ওই কমিটির সদস্য। অনিলবাবু আপাতত মেয়ের কাছে, হায়দরাবাদে। সেখান থেকেই তিনি দিল্লির ওই বৈঠকে যোগ দেবেন বলে জানিয়েছেন। এ কে জি ভবনের নেতাদেরও বক্তব্য, অনিলবাবুর ওই বৈঠকে যোগ দিতে সাংগঠনিক নিয়ম অনুযায়ী কোনও বাধা নেই। অবশ্য যদি না তার আগেই তাঁর বিরুদ্ধে অন্য কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
পলিটব্যুরোর নেতাদের বক্তব্য, অনিলবাবুর ক্ষেত্রে দু’রকম কৌশল নেওয়া যেতে পারে। এক, অনিলকে বহিষ্কার করে তাঁর মতো সব নেতাকেই কড়া বার্তা দেওয়া যেতে পারে। দুই, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আপাতত শান্ত করা যেতে পারে তাঁকে। পরে প্রয়োজন হলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। প্রথম ক্ষেত্রে যুক্তি হল, দলে যখন ‘শুদ্ধিকরণ’-এর ডাক দেওয়া হয়েছে, তখন বদ রক্ত বের করে দেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত এবং জরুরি। তার বদলে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরে নবীন প্রজন্মের নেতাদের তুলে আনার প্রক্রিয়া চলুক। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সমস্যা হল, নির্বাচনের সময় এই অনিল বসু, সুশান্ত ঘোষদেরই প্রয়োজন পড়বে দলের। কারণ, তাঁরাই মাঠেঘাটের রাজনীতি করা নেতা। গত লোকসভা নির্বাচনেও কলকাতার আশপাশে একমাত্র অনিলবাবুর পুরনো কেন্দ্রেই সিপিএম প্রার্থী জিতে আসতে পেরেছিলেন। অনিলবাবু বিধায়ক বা সাংসদ হলে দলের পক্ষে তাঁকে বহিষ্কার করাটা আরও বেশি সমস্যা হত। যেমনটা কবীর সুমনকে নিয়ে সমস্যায় পড়েছে তৃণমূল। তা ছাড়া রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তৃণমূলও অনিলকে ব্যবহার করতে পারে। কংগ্রেস অবশ্য আগেই সরব এ নিয়ে। রবিবার হুগলির মশাটে এক দলীয় কর্মসূচিতে কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান তৃণমূলের কড়া সমালোচনার পাশাপাশি একহাত নেন সিপিএম নেতা অনিল বসুকেও। তিনি বলেন, “অনিল বসু সাংবাদিক সম্মেলনে মা-মাটি-মানুষের কথা বলছেন। যদি তৃণমূল নেত্রী খুন-সন্ত্রাসের নায়ক অনিল বসুকে দলে নেন, তা হলে আশ্চর্য হবেন না।” এ প্রসঙ্গে বর্ধমানের মন্তেশ্বরের প্রাক্তন বিধায়ক আবু আয়েশ মণ্ডলকে তৃণমূল নেত্রী যে ভাবে দলে নিয়েছেন, সেই প্রসঙ্গ তুলে মান্নান অনিল বসু সম্পর্কে বলেন, “দুর্নীতিপরায়ণ আবু আয়েশ মণ্ডলকেও তৃণমূল নেত্রী দলে নিয়েছিলেন। ভোটেও দাঁড় করান। তৃণমূল কর্মীরাই ওঁকে হারিয়ে দেয়। এখন আবার একটি কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছে ওঁকে। এ ভাবেই অনিল বসুও ওই দলে ভিড়লে অবাক হওয়ার কিছু নেই।” তৃণমূল সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে সিপিএমের এই ঘরোয়া বিবাদ নিয়ে বিশেষ আগ্রহী নন। তিনিও মনে করছেন, জনমানসে অনিলের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই।
এই দুইয়ের টানাপোড়েনে পড়ে সিপিএম এখন তাই ‘সংশোধনবাদী’ ধীরে চলো নীতিই বেছে নিতে চাইছে। |