সত্তরের দশকে যখন নকশাল আন্দোলন হয়েছিল, তখন চিনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ছিলেন মাও জে দং। সেখান থেকে আজ হু জিনতাওয়ের চিন অনেকটাই পথ এগিয়ে এসেছে। পুঁজিপতিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চিনে শিল্পায়ন হয়েছে। আরও বেশি বাজারিকরণের পথে হেঁটেছে চিন।
এর সবটাই সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে হয়েছে কি না, চিনের এই সমাজতান্ত্রিক মডেলের পরিণতিই বা কী হবে, সে বিষয়ে এ বার ‘সুস্পষ্ট’ অবস্থান নিল সিপিএম। তা হল, চিনকে অনুকরণ তো নয়ই, অন্ধ সমর্থনও করবে না সিপিএম। পার্টি কংগ্রেসে চূড়ান্ত হওয়া মতাদর্শগত দলিলে বলা হল, চিনে সমাজতন্ত্র মজবুত করার লক্ষ্যে যে পদক্ষেপ করা হবে, শুধু তাতেই সিপিএমের সমর্থন থাকবে। চিন যখন নরেন্দ্র মোদীকে দেশে সাদরে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে, মমতা চিনের আমন্ত্রণে রাজ্যে চিনা বিনিয়োগের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে সে দেশে প্রতিনিধিদল পাঠাচ্ছেন, তখন চিনের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে নিজের মতো পথ চলতে চাইছে সিপিএম।
শুধু চিন নয়, সিপিএমের সামনে এত দিন ‘আদর্শ’ হিসেবে ছিল উত্তর কোরিয়াও। সিপিএম নেতাদের মুখে লেগে থাকত ‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারী’ উত্তর কোরিয়ায় আর্থিক উন্নয়নের জয়গান। কিন্তু পার্টি কংগ্রেসে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, উত্তর কোরিয়ায় যে ভাবে পরিবারতন্ত্র জাঁকিয়ে বসেছে, কিম জং ইলের মৃত্যুর পর যে ভাবে তাঁর পুত্র কিম জং উনের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে, তা কোন সমাজতন্ত্র? চাপে পড়ে এ বার তাই উত্তর কোরিয়া সম্পর্কেও সমালোচনার পথ নিয়েছে সিপিএম। মতাদর্শগত দলিলে উত্তর কোরিয়ার কড়া সমালোচনা করে বলা হয়েছে, শুধু ব্যক্তিপুজো বা পরিবারতন্ত্র নয়, এত বছরে কোরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি দেশের খাদ্য সমস্যাও মেটাতে পারেনি।
চিন, উত্তর কোরিয়া তো নয়ই, লাতিন আমেরিকার দিকেও বেশি ঝুঁকতে নারাজ সিপিএম। ‘পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও লাতিন আমেরিকা বিকল্প পথের সন্ধান দিচ্ছে’, এই যুক্তিতে মতাদর্শগত দলিল তৈরির সময় অনেক বিতর্ক হয়েছিল। খসড়া দলিলে বলিভিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডরের সরকারকে ‘বাম’ ও ‘প্রগতিশীল’ বলে আখ্যাও দেওয়া হয়। চূড়ান্ত দলিলে অবশ্য তাদের শুধু ‘বাম-মনস্ক’ তকমা দেওয়ারই সিদ্ধান্ত হয়েছে। লাতিন আমেরিকা সম্পর্কে দলের অবস্থান আরও স্পষ্ট করতে খসড়া দলিলে বলা হয়েছে, সাম্রাজ্যবাদ ও উদার অর্থনীতির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেও লাতিন আমেরিকা কিন্তু ‘সমাজতান্ত্রিক বিকল্প’ খাড়া করছে না। কাজেই লাতিন আমেরিকাকেই ‘সর্বরোগহর বটিকা’ হিসেবে বাছা যায় না।
সব কিছুই নেতিবাচক বলে খারিজ করে দিলে পড়ে থাকল কী? মতাদর্শগত দলিল তৈরির কাজে যুক্ত দলের এক পলিটব্যুরো নেতার জবাব, “এ হল সিপিএমের ভারতীয়করণের পথে আরও কয়েক পা এগোনো। এত দিন আমরা এই সব দেশের মডেলগুলিই আঁকড়ে ধরে থাকতাম। এ বার তার থেকে বেরিয়ে ভারতীয় বাস্তবতা অনুযায়ী আমাদের কর্মসূচি ঠিক করতে হবে। তাই অন্যান্য কমিউনিস্ট-শাসিত দেশের ভুলত্রুটিগুলিও খুঁজে বের করা প্রয়োজন।” একই সঙ্গে তাঁর ব্যাখ্যা, চিন, উত্তর কোরিয়া বা লাতিন আমেরিকা, কোনও মডেলকেই কিন্তু পুরোপুরি খারিজ করে দেওয়া হচ্ছে না। ‘চিনে সমাজতন্ত্র নেই’, এই যুক্তিও কোঝিকোড় পার্টি কংগ্রেসের বিতর্কে পুরোপুরি খারিজ হয়ে গিয়েছে। নেতিবাচক দিকগুলি খুঁজে বাদ দিয়ে যে বিষয়গুলি ভারতীয় বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই, সেগুলিই গ্রহণ করা হবে। উদাহরণ? চিনের মতো একনায়কতন্ত্র এ দেশে চলবে না। তাই ‘সর্বহারার একনায়কতন্ত্র’-র বদলে বেছে নিতে হবে ‘সর্বহারার রাষ্ট্রক্ষমতা’।
সিটু-র এক প্রবীণ নেতা বলছিলেন, চার বছর আগে বেজিং অলিম্পিকের সাফল্য দেখে অনেকে তাঁকে মজা করে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। আবার সাউথ আফ্রিকায় বিশ্বকাপ ফুটবলে উত্তর কোরিয়া যখন ব্রাজিল বা পর্তুগালের কাছে হারছে, তখন তাঁর মোবাইলে গভীর রাতে এসএমএস আসত, ‘তোমার দল তো হেরে গেল হে!’ ওই সিটু-নেতার বক্তব্য, “আর বোধহয় এই বিদ্রুপ সইতে হবে না!”
কিন্তু ভারতীয় পথের সন্ধান কবে মিলবে? তাঁর উত্তর, “এই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে ঠিক পৌঁছে যাব!” |