কাঙাল, আমারে কাঙাল করেছ
লোকে রাজা সাজে। উনি গরিব সেজেছেন।
ডিএসপি-তে পাকা চাকরি। স্বচ্ছল সংসার। ভাল-মন্দে দিব্যি দিন কেটে যায়। অথচ বিপিএল তালিকায় ওঁর নাম উঠেছে।
উনি এলেবেলে কেউ নন। খোদ ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম কাউন্সিলর সুধীর রুইদাস। বিপিএল তালিকায় নাম ওঠা নিয়ে বিরোধীরা হৈচৈ বাধালে দলেরও মুখ পুড়েছে। দলের জেলা সম্পাদক অমল হালদার বলেছেন, “এ সব বরদাস্ত করা হবে না।” এ বার আর তাঁকে টিকিট দেওয়া হয়নি। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েই গিয়েছে।
৩৩ নম্বর আক্ষরিক অর্থেই বস্তি-সর্বস্ব। ফরিদপুর গ্রাম ছাড়া বাকি প্রায় সবই বস্তি এলাকা। ডিএসপি ২ নম্বর গেট বস্তি, এএসপি গেট বস্তি, প্রমোদনগর বস্তি, আনসারিপাড়া, চাষিপাড়া, স্কুল বস্তি, ব্যাঙ্ক বস্তি, দক্ষিণমাঠ বস্তি, বাগদিপাড়া বস্তি, টালিগঞ্জপাড়া বস্তি, বাউরিপাড়া বস্তি, গাবটোনা বস্তি।
সুধীরবাবু দাবি, পানীয় জল, বিদ্যুৎ পৌঁছেছে সর্বত্র। কংক্রিটের রাস্তা হয়েছে প্রায় আটশো মিটার। নতুন পাকা নর্দমা গড়া হয়েছে প্রায় বারোশো মিটার। এ ছাড়াও বেশ কিছু নর্দমা সংস্কার করা হয়েছে। ৯০ জন বার্ধক্য ভাতা, ৭০ জন বিধবা ভাতা ও ৬ জন প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন। দু’টি শিশু শিক্ষাকেন্দ্র ও ৪টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের পাকা বাড়ি হয়েছে। একশো দিনের কাজে নর্দমা সাফাই, আগাছা পরিষ্কারের মাধ্যমে স্থানীয় বেকারদের কর্মসংস্থান হয়েছে।
বিরোধীরা পাল্টা বলছেন, উন্নয়নের ‘ফিরিস্তি’ আসলে সিন্ধুতে বিন্দু। বস্তি এলাকার উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ কেন্দ্রীয় প্রকল্পের রূপায়ণে কাউন্সিলর পুরোপুরি ব্যর্থ। স্থানীয় তৃণমূল নেতা মানিক রুইদাস বলেন, “এত বিশাল বস্তি এলাকা। অথচ একটিও কমিউনিটি শৌচাগার নেই। পানীয় জলের অভাব পুরো এলাকায়। জলের ধারা অতি ক্ষীণ।”

৩৩ নম্বরে বেহাল নিকাশি।

৩৪ নম্বরে তিরিল ঝুপড়িতে কাঁচা নর্দমা।
ক্ষোভ রয়েছে বাসিন্দাদেরও। ফরিদপুর গ্রামের বাসিন্দা সমীর নায়েকের আক্ষেপ, “এলাকার সব নোংরা জল গিয়ে পড়ে একটি পুকুরে। স্থানীয় আদিবাসীরা সেই জল ব্যবহার করেন। রীতিমতো অস্বাস্থ্যকর ব্যবস্থা।” দক্ষিণমাঠের শিপ্রা মণ্ডল, এএসপি গেট বস্তির প্রভাত বিশ্বাসদের ক্ষোভ , “নিয়মিত জঞ্জাল সাফাই হয় না। ডাস্টবিনও নেই। উপযুক্ত ওষুধ স্প্রে না করায় মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা।”
কিন্তু সব ছাপিয়ে উঠেছে কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগ। মানিকবাবুর বক্তব্য, “বিপিএল তালিকা নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। নিজের লোকেদের ঢুকিয়েছেন কাউন্সিলর। এমনকী নিজের নামও ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন। আমরা পুরসভায় দরবার করে নাম বাদ দেওয়াই।” সুধীরবাবু অবশ্য দাবি করেছেন, বিষয়টি তাঁর ‘অজ্ঞাতে’ ঘটেছিল। কিন্তু তাঁর নিজের দলের লোকেরাও সে কথা বিশ্বাস করেন কি না সন্দেহ। কয়েক দিন আগে পুরভোটের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করতে গিয়ে সিপিএমের জেলা সম্পাদক বলেন, “আর্থিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও যে দুই কাউন্সিলরের নাম বিপিএল তালিকায় ছিল, তাঁদের এক জনও এ বার প্রার্থী তালিকায় নেই।”
ওই দু’জনের এক জন সুধীরবাবু ও অপর জন ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রুমা পাল। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
৩৪ নম্বরের সিপিএম কাউন্সিলর সরোজিনী হাঁসদার বিরুদ্ধে অবশ্য ‘কাঙাল’ সাজার কোনও অভিযোগ নেই। পেশায় তিনি স্কুল শিক্ষিকা, পুরসভার মেয়র পারিষদ (সমাজকল্যাণ)-ও বটে। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, ওয়ার্ডের বেশির ভাগটাই ‘ডিএসপি-র এলাকা’ অজুহাত দিয়ে তিনি হাত গুটিয়ে বসে থেকেছেন। ফলে ওয়ার্ডের এখন ‘কাঙাল’ দশা।
গ্যামন কলোনি থেকে স্টাফ কোয়ার্টার, নেতাজিপাড়া, মাহাতোপাড়া, নতুনপল্লি, তিরিল ঝুপড়ি, খাটালপাড়া, শিমলি ঝুপড়ি, কাদা রোড এবং ওয়েলমেন কলোনি নিয়ে ৩৪ নম্বর্র। উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠলেই কাউন্সিলর দাবি করেন, গ্যামন কলোনি ও স্টাফ কোয়ার্টার ছাড়া তাঁর ওয়ার্ডের বাকি সব এলাকাই ডিএসপি-র। তাই ‘ইচ্ছা’ থাকলেও চাহিদা মতো উন্নয়নের কাজ করা যায়নি।
সরোজিনীদেবী জানান, মূলত ভিন্ রাজ্য ও জেলা থেকে আসা মানুষজনেরা এই এলাকায় থাকেন। এক কালে রাস্তা ও নিকাশির দুর্দশা থাকলেও এখন পরিস্থিতি ‘বেশ ভাল’। তাঁর দাবি, “প্রায় সব রাস্তাই হয় পিচ নয়তো কংক্রিটের করে ফেলা হয়েছে। কাদা রোড যৌনপল্লিতে পুকুর সংস্কার করা হয়েছে। সেখানে নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা শিবির করা হয়। ওয়েলমেন কলোনিতে বড় নর্দমা গড়া হয়েছে। বিভিন্ন এলাকা মিলিয়ে ১২টি কমিউনিটি শৌচাগার হয়েছে। দু’টি আদিবাসী সাংস্কৃতিক মঞ্চও গড়া হয়েছে।”
তৃণমূল নেতা সুব্রত ঘোষ অবশ্য অভিযোগ করেন, নিকাশি বেহাল। অধিকাংশ নর্দমা সংস্কার হয়নি। সামান্য বৃষ্টিতে ওয়েলমেন কলোনিতে জল জমে। নতুনপল্লি ও মাহাতোপাড়ায় রাস্তা বেহাল। ওয়ার্ডে কোনও শিশু শিক্ষাকেন্দ্র নেই। কমিউনিটি শৌচাগার থেকেও নেই। কারণ জলের অভাবে তা ব্যবহার করতে পারেন না বাসিন্দারা। কোনও কোনও শৌচাগারের দরজা ভাঙা। গরিবদের জন্য বিএসইউপি-র বাড়ি হয়নি একটিও।
সুব্রতবাবুর ক্ষোভ, “পানীয় জলের সঙ্কট রয়েছে। টিউবওয়েল যত গুলি আছে তার অধিকাংশই ডিএসপি বসিয়েছে। বস্তি এলাকার উন্নয়নের জন্য কিছুই করেননি কাউন্সিলর।” সরোজিনীদেবীর সাফাই, “ডিএসপি এলাকার জন্য বিএসিউপি বাড়ি তৈরি করা যায়নি। তিরিল ঝুপড়িতে জায়গা না মেলায় নর্দমা করা যায়নি।”
এলাকার বাসিন্দারা অবশ্য তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। শিমলি ঝুপড়ির বাসিন্দা আনন্দ মুর্মু বলেন, “নর্দমা সংস্কার না হওয়ায় জল জমে থাকে এলাকায়। রীতিমতো অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। আবর্জনাও সাফ করা হয় না।” নতুনপল্লির শেখ জামালের খেদ, “শুনেছি, ওয়ার্ডের উন্নয়নে প্রচুর অর্থ বরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু কাজ তো চোখে পড়ে না! আমরা সেই তিমিরেই পরে আছি।” বিপিএল তালিকায় গরমিল, স্বজনপোষণের অভিযোগ এনেছেন কাদা রোড ঝুপড়ির জরিনা বিবি। তিক্ত কন্ঠে নেতাজিপাড়ার মহম্মদ ইসলাম বলেন, “আমরা যে পুর এলাকায় থাকি, পরিষেবার বিচারে তা প্রমাণ করা দুঃসাধ্য!”
সুধীরবাবুর মতো সরোজিনী হাঁসদাকেও এ বার সরিয়ে দিয়েছে তাঁর দল। নতুন প্রার্থীরা কি প্রমাণ করতে পারবেন, যে তাঁরা ‘সর্বহারা’র পাশেই আছেন?

নজরে নগর
ওয়ার্ড ৩৩ ওয়ার্ড ৩৪
• বেহাল নিকাশি
• বস্তিতে কমিউনিটি শৌচাগার নেই
• বিপিএল তালিকায় গরমিল
• নিকাশি বেহাল
• বিএসইউপি প্রকল্পে বাড়ি হয়নি
• শিশুশিক্ষা কেন্দ্র নেই

কাজ হয়নি। শুধু স্বজনপোষণ
আর বিপিএল তালিকায় নিজের নাম।
মানিক রুইদাস,

বস্তির জন্য কাউন্সিলর কিছু করেননি।
টিউবওয়েল ডিএসপি-ই বসিয়েছে।
সুব্রত ঘোষ,

বিপিএল তালিকায় আমার নাম
কী ভাবে ঢুকল, জানি না।
সুধীর রুইদাস,

অধিকাংশ জায়গাই ডিএসপি-র। ইচ্ছা
সত্ত্বেও কাজ করা যায়নি।
সরোজিনী হাঁসদা,

ছবি: বিশ্বনাথ মশান।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.