সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে নিজের বিছানায় বসে প্রাণায়াম করতে বসলেন মন্ত্রীমশাই। বাম নাসারন্ধ্র চেপে ধরে ডান নাসারন্ধ্র দিয়ে সবে মাত্র শ্বাস টানতে শুরু করেছেন, এমন সময় মন্ত্রীমশায়ের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। শ্বাস টানা বন্ধ করে তিনি ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখেন রাজামশাইয়ের ফোন। ধরে বুঝলেন, জরুরি তলব। মন্ত্রীমশাই প্রাণায়াম ভুলে তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠে, তাড়াতাড়ি হাউস কোটটা গায়ে চাপিয়েই চললেন রাজামশায়ের কাছে।রাজামশাই দু’হাত কোমরের পেছনে রেখে বাগানে পায়চারি করছেন। মুখ গম্ভীর! যেন কোনও এক প্রশ্নের গভীরে গিয়ে উত্তর অনুসন্ধান করছেন তিনি। মন্ত্রীমশাই কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই রাজামশাই গলা খাঁকড়ানি দিয়ে বললেন, ‘মন্ত্রী, বেশ কিছু দিন ধরে আমি লক্ষ করছি আমার বাগানে পাখি আসা কমে গিয়েছে। আগে বাগানে এলে কত রকমের পাখি দেখতে পেতাম। কত রঙের! আবার বিশেষ বিশেষ ঋ
তুতে পরিযায়ী পাখিও দেখতে পেতাম বাগানের জলাশয়ে, গাছের ডালে। কিন্তু এখন পাখির আনাগোনা এত কমে গিয়েছে কেন? ব্যাপার কী?’ মন্ত্রীমশাই কী উত্তর দেবেন ঠিক বুঝে উঠে পারলেন না। বাগানের মালি গাছের পরিচর্যা করছিল। সে কাছে এসে হাত জোড় করে বলল, ‘মহারাজ, শুধু পাখিদের আনাগোনা কমেছে তা-ই নয়, গাছের ফলনও কমেছে, গড়নও বদলেছে।’ |
‘সে কী রকম?’ রাজামশাই ভ্রু কুঁচকে বললেন। মালি বলল, ‘আজ্ঞে মহারাজ, আগে বাগানের নারকেল গাছে কত নারকেল হত! রাজবাড়ির সবাই খাবার পরেও প্রজাদের বিলিয়ে দেওয়া হত। কত বড় বড় ডাব! কত জল ধরত তাতে! এক জন মানুষ জল খেয়ে শেষ করতে পারত না! আর এখন, ডাবও হয় কম আর তার গড়নও ভাল নয়। কেমন যেন শুকনো শুকনো।’ এ বার মন্ত্রীমশাই বললেন, ‘কথাটা তো ঠিক বলেছ!’ মালি বলল, ‘তার পর মহারাজ, লিচুর দিনে মৌচাকের মতন লিচু ঝুলত রাজবাগানের গাছের ডালে ডালে। আঙুরের দিনে থোকা থোকা আঙুর আর আপেলের সময় কত্ত আপেলই না হত! কিন্তু এখন এমনটি হয় না মহারাজ।’ ‘হুম্ম্!’ মহারাজ আরও চিন্তিত হয়ে পড়লেন। মন্ত্রীকে বললেন, ‘মন্ত্রী, এর উত্তর যদি তোমার না জানা থাকে তবে অনুসন্ধান করে তার যথাযথ ব্যবস্থা নাও।’ হুকুম করে রাজা চিন্তিত মনে হাঁটতে হাঁটতে অন্দরমহলের দিকে চলে গেলেন।
মন্ত্রীমশাই পড়লেন ভারী চিন্তায়। কী করা যায়, কী করা যায়। ইতিমধ্যেই খবরটা সারা রাজ্যে চাউর হয়ে গিয়েছে। যে উত্তর দিতে পারবে তার জন্য এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। সবাই যেন রাজার প্রশ্নের উত্তরই খুঁজতে লেগেছে; কিন্তু পায় আর না।
এর দিন কতক পর একটা বেঁটেখাটো, রোগাসোগা লোক এল রাজদরবারে। লোকটা নাকি প্রকৃতি বিশারদ। এসেই রাজামশাইকে লম্বা একটা সেলাম ঠুকে বলল, ‘মহারাজ, আপনার প্রশ্নের উত্তর আমি জানি।’ রাজামশাই কৌতূহলী হয়ে বললেন, ‘বলো তো শুনি। কী সে উত্তর।’ এমন সময় রাজামশাইয়ের বুক পকেটে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। উনি ফোনটা ধরলেন, ‘হ্যালো?’ ও প্রান্তে রানিমার কণ্ঠস্বর, ‘তোমার তো দুধ খাবার সময় হয়ে গেল, আসবে না?’ ‘যাচ্ছি।’ বলে ফোনটা কেটে দিলেন তিনি। তার পর লোকটাকে বললেন, ‘বলো, কী এর উত্তর?’ লোকটা হেসে বলল, ‘আজ্ঞে মহারাজ, উত্তর তো আপনার হাতের মুঠোয়।’ কথাটা শুনে শুধু রাজামশাইই নন, রাজসভায় উপস্থিত সবাই আবাক হয়ে গেল! রাজামশাই বললেন, ‘উত্তর আমার হাতের মুঠোয়! আমার হাতে তো মোবাইল ফোন রয়েছে!’ লোকটা ফিক করে হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, মহারাজ, আপনার হাতের মুঠোর ফোনটাই এর জন্য দায়ী।’ ‘মানে?’ ‘রাজবাড়ির মাথায় মোবাইলের যে টাওয়ারটা রয়েছে সেটার জন্যই এত কিছু। এই টাওয়ারের তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের জন্য পাখিদের জীবনযাত্রা বিপন্ন হচ্ছে আর ঠিক একই কারণে গাছেরা তাদের ফলন, রং হারাচ্ছে। ওই টাওয়ারের জন্যই পরিযায়ী পাখিরা রাজবাড়ি চিনতে পারে না। তারা ভাবে যে, অন্য জায়গায় চলে এসেছে। তাই তারা উড়ে যায় অন্য জায়গায়, রাজবাড়িতে তাদের দেখা মেলে না। শুধু তা-ই নয় মহারাজ, এই তরঙ্গ মানুষের স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি করছে নিঃশব্দে। সেটা আমরা এখন বুঝতে পারছি না, বুঝব অনেক দিন পর।’ রাজামশাই চিন্তিত হয়ে বললেন, ‘কিন্তু মোবাইল ফোন ব্যবহার না করলে আমি রাজকার্য চালাব কী করে? আমি আমার পারিষদদের সঙ্গে যোগাযোগ করব কী ভাবে? বিশেষ করে অসুবিধা হয় তোমাদের রানিমা বাপের বাড়িতে থাকলে। তখন তো ফোনটা খুবই জরুরি হয়ে পড়ে।’ লোকটা হেসে বলল, ‘মহারাজ, বেঁচে থাকার জন্য আমাদের সবই দরকার। মোবাইল ফোন দরকার, প্রকৃতির দরকার আবার শরীর-স্বাস্থ্যও দরকার। কোনওটাই বাদ দেওয়া
যায় না।’ ‘তা হলে উপায়?’ ‘উপায় আছে মহারাজ।’ ‘উপায় আছে!’ খুশিতে রাজামশাই
যেন সিংহাসন থেকে লাফিয়ে উঠলেন। ‘হ্যাঁ, মহারাজ, আছে। টাওয়ারটা যদি নগরের পশ্চিম প্রান্তে পরিত্যক্ত, নির্জন, নিস্ফলা জায়গায় বসানো হয় তো এর সুরাহা হয়। পাখিরা রাজবাড়ি চিনতে পারবে, লোকালয়ের ক্ষতি হবে না,
গাছেরা ভাল থাকবে আর আপনার রাজকার্যও চলবে ঠিকঠাক।’ রাজা
খুশি হয়ে মন্ত্রীমশাইকে বললেন, ‘মন্ত্রী, একে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার দাও আর কালকেই রাজবাড়ির মাথা থেকে টাওয়ারটা সরিয়ে নগরের পশ্চিম প্রান্তে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি দুধটা খেয়ে আসি।’
|