রাজ্যে বিগত সরকারের আমলে যা নিয়ে বিরোধীদের অভিযোগের অন্ত ছিল না, পরিবর্তনের পরেও দেখা যাচ্ছে, সেই ‘ঐতিহ্যে’ কোনও ছেদ পড়েনি। মেডিক্যাল কলেজকে ‘কনে সাজিয়ে’ পরিদর্শকদের ‘কুমিরছানা’ দেখানোর ঐতিহ্য।
গত বেশ ক’বছর ধরে রাজ্যের কোনও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এমসিআই (মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া)-এর পরিদর্শনের সময়ে সেখানে অন্য মেডিক্যাল কলেজ থেকে ধার করে চিকিৎসক নিয়ে যাওয়াটাই যেন দস্তুর! পূর্বতন বাম আমলে এমন একাধিক ঘটনা প্রকাশ্যে আসায় তদানীন্তন বিরোধীরা সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন। কিন্তু নতুন জমানাতেও একই প্রবণতা অব্যাহত। চিকিৎসকের ব্যবস্থা না-করেই মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যাবৃদ্ধির দৌড়ে নেমে পড়েছে সরকার, ফলে পরিদর্শনের সময়ে খাস কলকাতার একাধিক মেডিক্যাল কলেজ খালি করে চিকিৎসকদের অন্যত্র পাঠানো হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না সুপার স্পেশ্যালিটি বিভাগগুলোও।
এবং চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ এখন প্রশ্ন তুলেছন, একই ডাক্তারকে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে ‘কুমিরছানার’ মতো করে দেখানোর এই ট্র্যাডিশনে কেন ‘পরিবর্তন’ এল না? সদ্যই কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল, আরজিকর, এসএসকেএম থেকে চিকিৎসকদের পাঠানো হয়েছে এনআরএস এবং মালদহ মেডিক্যালে। পরিদর্শকদের সন্তুষ্ট করতে। ফলে ওই তিন হাসপাতালে বিভিন্ন বিভাগে কাজকর্ম শিকেয় উঠেছে। ওখানকার কর্তৃপক্ষেরা জানান, এপ্রিলের মাঝামাঝি তাঁদের চিকিৎসকদের সরানোর সময়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, এপ্রিলের মধ্যে সকলকে ফেরত পাঠানো হবে। তা হয়নি।
স্বভাবতই ভোগান্তির একশেষ হচ্ছে রোগীদের। ওই সব চিকিৎসকের রোগীরা এসে ফিরে যাচ্ছেন। অনেকের পূর্ব নির্ধারিত অস্ত্রোপচার বাতিল করতে হচ্ছে। এমনকী, বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজও থমকে রয়েছে। এখানেই শেষ নয়। রাজ্যে শিশুদের একমাত্র রেফারেল হাসপাতাল বি সি রায়ের একমাত্র রেডিওলজিস্টকেও এমসিআই-পরিদর্শন উপলক্ষ্যে এনআরএসে পাঠিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর!
ফলে গত প্রায় পনেরো দিন ধরে বি সি রায়ে রোগীদের আল্ট্রাসোনোগ্রাফি পুরোপুরি বন্ধ। গুরুতর অসুস্থ শিশুদেরও আল্ট্রাসোনোগ্রাফির জন্য আশপাশের হাসপাতালে রেফার করা হচ্ছে। যাতায়াতের ধকলে তাদের শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। যে হাসপাতালে শিশুমৃত্যু নিয়ে ক’মাস আগেই প্রবল শোরগোল হয়েছিল, সেখানে এই অবস্থা কেন?
হাসপাতালের কর্তারা সদুত্তর দিতে পারেননি। এমসিআইয়ের পরিদর্শন ২১ এপ্রিল শেষ হওয়ার পরেও কেন রেডিওলজিস্টকে বিসি রায়ে ফেরত পাঠানো হল না, এনআরএস-কর্তৃপক্ষও সে প্রশ্নের জবাব এড়িয়েছেন। এনআরএসের অধ্যক্ষ প্রদীপ ঘোষের বক্তব্য, এমন কিছু হয়েছে বলে তাঁর মনেই পড়ছে না। ন্যাশনাল থেকে অন্যত্র পাঠানো এক ডাক্তারের আক্ষেপ, “আমাকে চিঠি দিয়ে ১৬ এপ্রিল কলকাতার অন্য একটা মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো হল। বলা হয়েছিল, পরিদর্শন হয়ে যাওয়ার দু’-এক দিনের মধ্যে পুরনো জায়গায় কাজ শুরু করতে পারব। যাঁরা ই কথা বলেছিলেন, তাঁরা এখন মুখে কুলুপ এঁটেছেন!”
সঙ্কটের সুরাহা কী? স্বাস্থ্য দফতর কী বলছে?
রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমাদের কিছু করার নেই। এ ভাবেই চালাতে হবে। ছ’শো শিক্ষক-চিকিৎসক চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছি। দেখা যাক, কত জন পাওয়া যায়। রাতারাতি তো অভাব মিটবে না।” তা হলে কি আগামী ক’বছর এ ভাবেই চলবে?
সুশান্তবাবুর সাফ জবাব, “এ ভাবেই চলে আসছে, এ ভাবেই চলবে। সবাই সব জানে।”
যদিও দিল্লিতে এমসিআই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা জানিয়েছেন, চিকিৎসক ধার করে আনার ব্যাপারটা প্রমাণিত হলে নতুন মেডিক্যাল কলেজকে অনুমোদন তো দেওয়া হয়ই না, উপরন্তু ভবিষ্যতে অনুমোদনের ক্ষেত্রে আরও কড়াকড়ি হতে পারে। সর্বোপরি, এ ভাবে ‘কনে সাজিয়ে’ মেডিক্যাল কলেজের অনুমোদন আদায় করে মেডিক্যাল-শিক্ষার মানের সঙ্গেই আপস করা হচ্ছে না কি?
রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার জবাব, “আমরা তবু অনেক ভাল। অন্য অনেক রাজ্যের কথা জানি, যারা এর চেয়েও বেশি করে।” |