আর কিছু দিন অপেক্ষা করে রাজ্যের স্বার্থে আন্দোলন, জানিয়ে রাখলেন নেত্রী
বিচার চেয়ে পেলেন বিবেচনার আশ্বাস
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিন বছরের জন্য ‘মোরাটোরিয়ামের’ যে প্রস্তাব, তা আজ খতিয়ে দেখার সুনির্দিষ্ট আশ্বাস দিলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠকে চূড়ান্ত কোনও সমাধান সূত্র বেরিয়ে না এলেও কেন্দ্রের পক্ষ থেকে ‘মোরাটোরিয়ামের’ প্রশ্নে যে শর্ত তাঁর সামনে রাখা হয়েছিল, তা আজ তিনি প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছেন। মমতা প্রধানমন্ত্রীকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্যের স্বার্থে কোনও শর্ত মানতে নারাজ তিনি। তবে সুদ-আসল বাবদ বছরে ২২ হাজার কোটি টাকা মকুবের বিষয়ে মমতা চূড়ান্ত সময়সীমা বেঁধে না দিলেও বৈঠক শেষে বলেছেন, “প্যাকেজ নয়, বিচার চাইতে এসেছি। রাজ্যের স্বার্থে তাই মাঝামাঝি কোনও রাস্তায় হাঁটতে চাই না।” তা হলে কী করবেন তিনি? কৌশলী মমতা এ দিন প্রকারান্তরে হুঁশিয়ারি দিয়েই জানিয়েছেন, জনতার কথা ভেবে আরও কিছু দিন অপেক্ষা করা হবে। তার পর প্রয়োজনে রাজ্যে আন্দোলন শুরু হবে।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে যে ভাবে আজ মমতা রাজ্যের স্বার্থে মুখ খুলেছেন, তাতে মনে করা হচ্ছে, গত এক বছর ধরে অর্থ সাহায্য নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য যে টানাপোড়েন চলছে, তা চূড়ান্ত জায়গায় উপনীত হল। আর সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে অনেকেই মনে করছেন, আজকের বৈঠকের পরে কিন্তু পাল্লা ভারী মমতার দিকেই। কারণ, আর দু’মাসের মধ্যেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। সেই নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থী জেতাতে হলে তৃণমূলের সাহায্য প্রয়োজন কংগ্রেসের। তাই রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের ঠিক আগে এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মমতাকে চটানোর ঝুঁকি নিতে চাইছেন না কংগ্রেস নেতৃত্ব।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সামনে। শুক্রবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই
প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্রে বলা হচ্ছে, আজকের বৈঠকের পর মমতার দাবি মেনে পশ্চিমবঙ্গকে কী ভাবে সাহায্য করা যায়, তা নিয়ে অর্থ মন্ত্রককে খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে এই আশ্বাস পেলেও তৃণমূল নেত্রী আজ জানিয়েছেন, “গত এক বছরে রাজ্যের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দশ বার ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কুড়ি বার বৈঠক হয়েছে। কোনও সমাধান সূত্র বেরোয়নি। তাই না আঁচালে বিশ্বাস নেই।”
এ বারের দিল্লি সফরে রাজ্যের অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াইয়ে প্রথম থেকেই সরব রয়েছেন মমতা। এবং এই কাজে তিনি কতটা তৈরি হয়ে এসেছেন, সেটা তাঁর এ দিনের ‘প্রস্তুতি’ থেকেই স্পষ্ট। আজকের বৈঠকে তিনি কোনও নথিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ নিয়ে যাননি। খালি হাতেই যান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। বৈঠকে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে স্পষ্ট জানান, গত ৩৪ বছরের ঋণের বোঝা বইতে তিনি অক্ষম। কারণ, রাজ্যের আয় বছরে যেখানে ২১ হাজার কোটি, সেখানে সুদ-আসল বাবদ মেটাতে খরচ হচ্ছে ২২ হাজার কোটি টাকা। তৃণমূল সূত্রের খবর, সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার দোহাই দিয়ে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে রাজ্যের জন্য মধ্যবর্তী রাস্তায় চলার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
মধ্যপন্থা হিসেবে অর্থ মন্ত্রকের প্রস্তাব ছিল, তিন বছরের জন্য রাজ্যকে ছাড় দিতে রাজি আছে কেন্দ্র। সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গ যে রাজস্ব সংগ্রহ করবে, তা দিয়ে তারা বরং পরের দু’বছরে বকেয়ার একটা বড় অংশ শোধ করুক। কেন্দ্রীয় সাহায্য দেওয়ার বদলে রাজ্যকে বাজার থেকে অতিরিক্ত ঋণ পাইয়ে দেওয়ার প্রস্তাবও করেছিল অর্থ মন্ত্রক। স্বভাবতই কেন্দ্রের ওই শর্তাবলি মানতে রাজি হননি মমতা। তিনি সে কথা আজ স্পষ্ট জানিয়েও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে। রাজ্যের বক্তব্য, ঋণের বোঝা লাঘব করতে শুধু তিন বছরের জন্য সুদ ও আসল দেওয়া স্থগিত রাখাই নয়, সামগ্রিক ভাবে কেন্দ্রকে আংশিক ঋণ মকুব, সুদের হার কমানো এবং ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বৃদ্ধি করার কথা ঘোষণা করে গোটা ঋণের কাঠামোটাই ঢেলে সাজতে হবে। মমতার বক্তব্য, রাজ্যের পক্ষ থেকে যে দীর্ঘমেয়াদি সাহায্যের আশ্বাস চাওয়া হয়েছে, তা-ই দিতে হবে। পশ্চিমবঙ্গকে অন্য রাজ্যের সঙ্গে এক পংক্তিতে না রেখে বরঞ্চ কেন্দ্র যাতে রাজ্যের প্রতি বিশেষ নজর দেয়, সেই দাবিও করেছেন তিনি। মমতার যুক্তি, “পরিবারের একাধিক সন্তানের মধ্যে যদি কোনও একটি সন্তান শারীরিক ভাবে অশক্ত হয়, তখন বাবা-মা তাকে অতিরিক্ত দেখভাল করে। তেমনি গোটা দেশের আর্থিক অবস্থা সুষম না হলে সার্বিক ভাবে দেশের উন্নতি হবে কী করে?”
এক দিকে দু’মাসের মধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। অন্য দিকে, ক্ষমতায় আসার পর থেকেই অ-কংগ্রেসি এবং অ-বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন মমতা, যা কংগ্রেস নেতৃত্বের কাছে যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ। তাই মমতা বুধবার দিল্লি আসার পরেই মনমোহন সিংহ, সনিয়া গাঁধী ও প্রণব মুখোপাধ্যায় নিজেদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে একটি বৈঠকও করেন। যা কার্যত নজিরবিহীন বলেই মনে করা হচ্ছে। কংগ্রেস নেতৃত্বের আরও আশঙ্কা, আর্থিক সাহায্য না পেলে মমতা আগামী দিনে কেন্দ্র-বিরোধী অবস্থান নিতে পারেন। সংসদের উভয় কক্ষে বর্তমানে তৃণমূলের যা শক্তি তাতে আগামী দু’বছর কেন্দ্রে কংগ্রেসের পক্ষে সরকার চালানো ক্রমশ দুষ্কর হয়ে পড়বে।
এমনই সন্ধিক্ষণে আজ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন মমতা। এ যাবৎ কেন্দ্র তথা অর্থ মন্ত্রকের দাবি ছিল, কেবল একটি রাজ্যের জন্য বিশেষ কোনও সাহায্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বাধা রয়েছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, কেরল এবং পঞ্জাবকেও ঋণগ্রস্ত রাজ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রকের বক্তব্য ছিল, শুধু পশ্চিমবঙ্গ ওই সাহায্য পেলে সে ক্ষেত্রে পঞ্জাব বা কেরল তো বটেই, বিহারের নীতীশকুমার কিংবা তামিলনাড়ুর জয়ললিতাও কেন্দ্রকে ছেড়ে কথা বলবেন না। সেই যুক্তির জবাবে আজ মমতা প্রধানমন্ত্রীর কাছে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন এক দশক আগে পঞ্জাবকে অর্থ সাহায্য দেওয়ার কথা এবং মনে করিয়ে দেন, তখনও আর্থিক দায়িত্ব ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন চালু ছিল। তৃণমূল সূত্রের দাবি, মমতার ওই যুক্তি মেনে নেন প্রধানমন্ত্রী। বাম আমলের নেওয়া ঋণ মকুব করার যে দাবি রাজ্য জানিয়েছিল, তা নিয়েও আপত্তি ছিল অর্থ মন্ত্রকের। যুক্তি ছিল, আগের সরকারের ঋণ বর্তমান সরকারকেই শোধ করতে হবে। তা খণ্ডন করে মমতার বক্তব্য, আগের সরকারকে ঋণ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রক। তাই সেই ঋণ মুকুব করার অধিকারও অর্থ মন্ত্রকের হাতেই রয়েছে।
বেহাল আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে গত এক বছর ধরেই কেন্দ্রীয় সাহায্যের জন্য দরবার করে আসছে রাজ্য। তৃণমূল নেতৃত্বের বক্তব্য, গত ৩৪ বছর ধরে ওভারড্রাফ্ট করে কেন্দ্রের কাছ থেকে টাকা ধার করে গিয়েছে বাম সরকার। সাম্প্রতিক কালে প্রণব মুখোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী থাকাকালীনও বিগত বাম সরকারকে বিভিন্ন ভাবে ঋণ পাইয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তৃণমূল শিবিরের দাবি, এর ফলে এক টাকার মধ্যে ৯৭ পয়সা চলে যাচ্ছে যোজনা বর্হিভূত খাতে। রাজ্যের মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় দু’লক্ষ কোটি টাকা। এই ঋণের বোঝা এমন একটি জায়গায় পৌঁছেছে যে, রাজ্যের মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছা থাকলেও সরকার তা করতে পারছে না। ফলে রাজ্যের উন্নয়ন থমকে যাচ্ছে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.