|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
পাঠকদেরও কিছুটা উদারদৃষ্টি হওয়া চাই |
সুধীর চক্রবর্তী |
সুনীলকে লেখা চিঠি। ভূমিকা/টীকা: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তালপাতা, ২০০.০০ |
সাগরময় ঘোষকে তাঁর আশি-পেরোনো বয়সে একবার বলেছিলাম একটা আত্মজীবনী লিখতে। উত্তরে বলেছিলেন, তাঁর স্মৃতি ধূসর হয়ে এসেছে, আগের কথা পরে আর পরের কথা আগে এসে গোল পাকিয়ে যায়। তবে তাঁর কাছে আছে বহু বিখ্যাত ব্যক্তির লেখা অনেক চিঠি। সেগুলি যদি কেউ সাজিয়ে গুছিয়ে বার করে, তা হলে ঘটবে এক ঐতিহাসিক উন্মোচন। সে কাজ অনারব্ধ থেকে গেল। কিন্তু এই মুহূর্তে হাতে পাচ্ছি সদ্য প্রকাশিত এক চমৎকার পত্রসংকলন, সুনীলকে লেখা চিঠি, যার ভূমিকা আর টীকা সংযোগ করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজেই। ১৯৫৪-র ১৭ জানুয়ারিতে পাঠানো নীহাররঞ্জন রায়ের চিঠি দিয়ে শুরু এবং ২০১১-র ১৭ ডিসেম্বরে লেখা শঙ্খ ঘোষের চিঠি দিয়ে সমাপন। মোট ৬৭ জন খ্যাত বা অনতিখ্যাত ব্যক্তির (যার মধ্যে দু’জন বিদেশি) লেখা আশ্চর্য সব চিঠি (কারও একটা, কারও বা অনেক) পড়তে পড়তে মনে নানা রকম আভা খেলে যায়। আমাদের লাভ হল, এ সব চিঠির অন্তরাল থেকে লেখকদের একটা অন্য রকম মেজাজ ও আত্মসংকট বা অভিলাষের কথা প্রচ্ছন্ন ভাবে ফুটে উঠেছে। সেই সঙ্গে সর্বদা জাগরুক হয়ে আছে চিঠিগুলির প্রাপকের প্রসন্ন উদার চরিত, অনুকম্পায়ী মন ও ব্যক্তি সম্পর্কের ব্যাপ্তিপরিচয়। বন্ধুবৎসল, মরমি পত্রলেখক, সংযোগকামী সুনীল নানা বয়সের আর নানা মাপের মানুষের সঙ্গে এতটাই মিশতে পেরেছেন যে তাঁরা অকপটে জানিয়েছেন তাঁদের গোপন বাঞ্ছা, একান্ত আপন মনোবেদনা, ঔপলক্ষিক আনন্দ আর কোনও বিশেষ বিষয়ে বিচিত্র তির্যক মন্তব্য। সব সময় খ্যাতনামারা তাঁকে চিঠি দিয়েছেন তা নয়। যেমন সুনীলের লেখকবন্ধু উদয়ন ঘোষ নিজের মর্মদাহ জানিয়ে লিখছেন, ‘সুনীল, আমার কোথাও মন নেই।... আমি খুব সাধারণ আছি, সুনীল’। এখনকার বিখ্যাত এক কবি তাঁর ‘সুনীলদা’কে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন ‘আমার সেই দহনের কোনো শেষ নেই... এই জ্বালা এই কষ্ট আমাকে সহ্যের সীমার ওপারে ঠেলে ফেলতে চাইছে আমি আর পারছিনা।’
এ ধরনের চিঠি পড়লে বোঝা যায়, সুনীল তাঁর সারস্বত সাধনার একাগ্রতার ধ্যানে এবং বহুবিধ প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বের মধ্যেও সংবেদনশীল মানবতাবোধে এতটা দীপ্র যে অনেকে তাঁকে আশ্রয়স্থল ভেবেছেন। এর পাশে মজা করে পড়ে নিতে হবে বন্ধু তারাপদ রায়ের চিঠি, যার সম্বোধন হল ‘গাঙ্গুলিমশাই’। টাঙ্গাইলে গিয়ে তাঁর বসন্তরোগ হওয়ার পরের পত্রযোগে বর্ণনা হল: ‘বর্তমানে ভালো হয়ে গেছি তবে একেবারে চিতাবাঘের মতো, পাকা কাঁঠালের মতো চিত্রবিচিত্র হয়ে গেছি। ইচ্ছে হলে নিজেকে এখন সচিত্র তারাপদ রায় বলে বিজ্ঞাপিত করতে পারি।’ সংকলক সুনীলের মুন্সিয়ানা ধরা পড়ে, যখন সত্যজিৎ রায়ের দু’টি কেজো চিঠি বেছে নেন, যার বিষয় হল ‘সন্দেশ’ পত্রিকার জন্যে লেখা চাওয়া। সাগরময় ১ এপ্রিল ১৯৭৮-এ লিখছেন: ‘২২ এপ্রিলের মধ্যে অন্তত চারটি কিস্তির মতো লেখা হাতে পাওয়া চাই। তারপর প্রতি শনিবার একটি করে কিস্তি দিয়ে যেতেই হবে।’ এ হল ‘সেই সময়’ উপন্যাস সূচনার নেপথ্য কথা।
অনুমানে সবাই বুঝবেন, জীবনের যত চিঠি সুনীল পেয়েছেন, তার সামান্য অংশ এ বইতে আছে। অনেক ঝাড়াই-বাছাই, বিবেচনা ও ব্যক্তি-অনুষঙ্গ মনে রেখে এ সব চিঠি সংকলিত, এর নেপথ্যবিধানে সম্পাদক সুনীলের নিশ্চিত দায়িত্ববোধ ক্রিয়াশীল। তবু চিঠি নির্বাচনে তিনি অকপট, সাহসী এবং অকারণে সতর্ক নন। তাঁর সময় আর বন্ধুবৃত্তকে এই পত্রালিবাহারে বেশ বর্ণময় ভাবে পাই যাতে নীতিবাদ বা শুচিতাবোধের তত বালাই নেই। সেই জন্যই এমন ব্যতিক্রমী পত্র সংকলনের পাঠককে হতে হবে উদার। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের খুব একটা শুদ্ধ চারিত্র্যমূর্তি নির্মাণ কিংবা প্রবক্তা হওয়ার বাই নেই। চিঠিগুলি সেই স্বচ্ছ মনে বাছাই করা বলে পাঠকদের খানিকটা উদারদৃষ্টি হওয়া চাই।
সুনীলকে লেখা চিঠি যে কোনও দিন বইয়ের মধ্যে মুদ্রিত হয়ে লোকলোচনের সামনে অবারিত হয়ে যাবে তেমন আশঙ্কা পত্রলেখকদের ছিল না, ফলে অনেক চিঠি বেশ আকর্ষণীয় লাগে তার স্বীকারোক্তিধর্মী রহস্যময়তায় সন্দীপন ও শরতের চিঠি চমৎকার এ ব্যাপারে। যেমন ধরা যাক ১৯৬০-এ বিদেশ থেকে পাঠানো চিঠিতে শরৎকুমার নীলনয়নাদের সম্পর্কে লিখেছেন: ‘নিষ্কাম বন্ধুত্বে এরা বিশ্বাস করে না, সকাম প্রণয়ের অবশ্যম্ভাবী পরিণতির জন্য পীড়াপীড়ি করে।’ অনেক চিঠি একেবারে রসের আকর, আর লিখেছেনও দিকপালরা। সৈয়দ মুজতবা আলির ইংরেজি বাংলা সংকর গদ্যে লেখা চিঠি একটু উদ্ধৃত করব। লিখছেন: ‘Of course Gurudev also knew of your coming, as the sages from the East knew of the nativity of Christ & composed গাঙ্গুলি মোর শৈবালের দল but due to sheer jealousy the Visvabharati tries to efface you by printing it as গানগুলি মোর শৈবালের দল।’
বক্তব্যের গুরুত্বে এবং চিন্তনে বেশ ক’টি চিঠি বারে বারে পড়তে হয়। সে সব চিঠির লেখকরা সোমনাথ হোর, রণজিৎ গুহ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, বাণী বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় আর শঙ্খ ঘোষ। এ সব চিঠি মাত্রাগত ভাবে অনেক দিকদর্শী ভাবনার ইঙ্গিতবাহী এবং পত্রলেখকদের অবস্থানঘটিত ব্যক্তিগত আত্মকথনে সমৃদ্ধ। বোঝা যাচ্ছে চিঠিগুলির প্রাপক প্রেরকদের কতটাই উদ্দীপ্ত করতে পেরেছেন। তাই মাঝে মাঝে মনে হয়, চিঠিগুলি পড়তে পড়তে, যে, এক হাতে যেমন তালি বাজে না, তেমনই যদি পড়তে পাওয়া যেত এ সব চিঠির সাথ্সঙ্গতে সুনীলের লেখা চিঠিগুলি, তবে বেজে উঠত এক উজ্জীবিত বহুস্বর মুখরিত কালের মন্দিরা। বিচিত্র ধরনের মানুষের লাবণ্যময় পত্ররচনার পটে দু’খানি দীর্ঘ চিঠি মনে হল সোনার ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো। প্রথমটি কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় আর দ্বিতীয়টি মন্দাক্রান্তা সেনের লেখা। এমন চিঠি পড়তে পাওয়ায় নিজেকে খানিকটা শিক্ষিত করা গেল। সুনীলকে কৃতজ্ঞতা জানাই। |
|
|
|
|
|