ব্যাগ গুছিয়ে...

মোহিনী ম্যাকাও
ক্ষিণ চিন উপসাগরের জল কেটে এগিয়ে চলেছে জমকালো কোটাই জেট। হংকং বিমানবন্দর থেকে মিনিট পঁয়তাল্লিশের পথ। বাতানুকূল নৌকার কামরা থেকে বাইরের নতুন পৃথিবীটা আবছা, ফোঁটা ফোঁটা জল ভিজিয়ে দিয়েছে কাচ। ফেরি থামল তাইপা দ্বীপে। শুরু হল ঝটিকা সফর।
পৌঁছে গিয়েছি ম্যাকাও। বলা যেতে পারে শহর কিংবা এক চিলতে দেশও। তাইপা আর ম্যাকাও পেনিনসুলার এই দুই দ্বীপকে জুড়েছে তিনটে সেতু। নীচে বইছে পার্ল নদী। ম্যাকাও আগে ছিল পর্তুগিজদের অধীন। এখন চিন প্রজাতন্ত্রের বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল। সেখানে প্রকৃতি আর সভ্যতা মিশে গিয়েছে। এক দিকে ঝাঁ-চকচকে রাস্তা ছুটেছে দু’ধারে পার্ল নদীকে সঙ্গী করে। দূরে আকাশের গায়ে মিশে থাকা পাহাড়ের গা-ঘেঁষে মাথা তুলেছে সারি সারি আকাশ-ছোঁয়া অট্টালিকা, চোখ ধাঁধানো বিলাসবহুল হোটেল আর অগুনতি ক্যাসিনো। পর্যটন আর অভিজাত জুয়াখেলা এই দুটোই ম্যাকাও-অর্থনীতির ধারক।
জমকালো কোটাই স্ট্রিপই হোক বা স্থানীয় বাজার সেনাডো স্কোয়্যার কোথাও এতটুকু অপরিচ্ছন্নতা নেই। ম্যাকাও পেনিনসুলারের প্রাণকেন্দ্র এই সেনাডো স্কোয়্যার। তকতকে বাঁধানো রাস্তার দু’ধারে সারি সারি দোকান। অনেকটা আমাদের গড়িয়াহাটের মতো। আর সেই সব দোকানে হালফ্যাশানের জামাকাপড় থেকে শুরু করে জুতো, ঘর সাজানোর জিনিস, খেলনা, চিনে পুতুল কী নেই! শুধু দোকানের নামগুলো পড়তে পারা মুশকিল। কারণ সবই চৈনিক লিপিতে। অবশ্য কোথাও কোথাও কিছু পর্তুগিজ নামও চোখে পড়বে।
আর আছে বিচিত্র সব খাবারের দোকান। সেগুলোর সামনে দাঁড়ালে বোকা বনে যেতে হয়। কারণ চোখের সামনে থরে থরে সাজিয়ে রাখা বস্তুগুলোর বেশির ভাগটাই অচেনা। হলুদ হলুদ চিপ্সের মতো দেখতে ফিনফিনে কিছু জিনিস প্যাকেটে মোড়া। তবে গন্ধ জানান দিচ্ছে, ব্যাপারটা ঠিক নিরাপদ পোট্যাটো চিপ্স নয়। চিনে দোকানির ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বোঝা গেল ওগুলো আসলে ‘ড্রায়েড ইয়েলো ফিস’। অর্থাৎ শুকনো মাছ, যেগুলো বাড়ি নিয়ে গিয়ে তেলে ভেজে খেতে হয়। শুধু তাই নয়। বিচিত্রদর্শন পাখির রোস্ট, কুকুরের লেগপিস, সি-হর্স-ফ্রাই বা আস্ত শুওরের রোস্ট সবই ‘ডেলিকেসি’। তবে নিরীহ ডাল-ভাত খাওয়া বাঙালির পেটে সে সব কি আর সইবে? অগত্যা কেবল ফ্রেমবন্দি করা ছাড়া গতি নেই!
সময় খুব কম। কাজেই সেনাডো স্কোয়্যার থেকে চারপাশটা চটপট ঘুরে নেওয়া যায়। আছে সেন্ট পল্স গির্জার ধ্বংসাবশেষ, ৪২২ বছরের পুরনো সেক্রেড আর্ট মিউজিয়াম। খ্রিস্ট, মেরি এবং সমসাময়িক ইতিহাসের অসাধারণ সব নজির মিলবে এখানে। এ ছাড়া রয়েছে মিউজিয়াম অফ দ্য হোলি হাউজ অফ মার্সি, লাউ কাউ ম্যানসন, সাম কাই ভুই কুন টেম্পল, ক্যাথিড্রাল, লিসবোয়া ক্যাসিনো। সব মিলিয়ে ম্যাকাওয়ের শহুরে জীবনের আসল স্বাদ পাওয়া যাবে এখানেই।
ঘুরে দেখার মতো আরও বেশ কিছু জায়গা রয়েছে। রয়েছে কোলোয়ান আর তাইপা গ্রাম, জেলেদের বসতি, হাক সা সৈকত, পেনহা পাহাড়, গ্রঁ প্রি মিউজিয়াম, ম্যাকাও টাওয়ার তালিকাটা নেহাত ছোট নয়। আর ওই যে বললাম, শহুরে সভ্যতার বাড়বাড়ন্ত আর নৈসর্গিক শোভা যেটা চাই সেটাই ম্যাকাও হাজির করবে নিমেষে।
ম্যাকাও পেনিনসুলার ঘুরে ফিরে আসা যাক তাইপা দ্বীপে। তাইপার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ কোটাই স্ট্রিপ। বিশ্বের তাবড় তাবড় সংস্থা বিলাসবহুল হোটেল আর ক্যাসিনো খুলেছে এখানে। সেই সাম্রাজ্যেই আর একটা নতুন পালক যোগ হল গত সম্প্রতি ‘স্যান্ডস্ কোটাই সেন্ট্রাল’। একটা নয়, তিন-তিনটে হোটেল মিলে তৈরি হয়েছে স্যান্ডস্ কোটাই। তাদের মধ্যে কনরাড আর হলিডে ইন-এর উদ্বোধন হল সম্প্রতি। শেরাটনকে আর কিছু দিনের মধ্যেই খুলে দেওয়া হবে অতিথিদের জন্য।
তবে শুধু হোটেল বললে সত্যের অপলাপ হবে। পুরো পৃথিবীটাই যেন চলে এসেছে এক ছাদের তলায়, বা বলা ভাল, তিন ছাদের তলায়। পরপর তিনটে হোটেলের টাওয়ার মাথা তুলেছে আকাশে। তাদের মধ্যে পাঁচতারা কনরাড ৩৯তলার হোটেল। পাশাপাশি রয়েছে শেরাটন আর হলিডে ইন। তিনটি হোটেলই উচ্চবিত্ত নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের শেষ কথা। মোট ৫৮০০টি ঘর বৈভব, প্রাচুর্য আর রুচিশীলতার এক অনবদ্য সমন্বয়। কনরাডের ৩৭তলার ঘর থেকে নীচে তাকালাম। মনে হল, ছবির মতো ম্যাকাও শহর তার মায়াবী জাল বিছিয়ে রেখেছে। যেন রয়েছি অন্য কোনও এক অচেনা পৃথিবীতে।
লাস ভেগাস স্যান্ডস্ গ্রুপের কর্ণধার এবং ‘স্যান্ডস্ কোটাই সেন্ট্রাল’-এর অন্যতম রূপকার শেলডন জি অ্যাডেলসন জানালেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবাসীদের বিনোদনের সেরা ঠিকানা হতে পারে প্রাচ্যের ‘লাস ভেগাস’ এই স্যান্ডস্ কোটাই। প্রায় ৫৫০ কোটি আমেরিকান ডলার (অর্থাৎ প্রায় ২৮,৬০০ কোটি টাকা) খরচ করে তৈরি স্যান্ডস্ কোটাই-ই এখানকার প্রথম ‘ইন্টিগ্রেটেড রিসর্ট সিটি’।
আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন উপলক্ষে সেজে ওঠা ‘স্যান্ড্স কোটাই সেন্ট্রাল’ যেন রূপকথার জগৎ। কোথাও চৈনিক উপকথার পাতা থেকে উঠে আসা ‘টেরাকোটা ওয়ারিয়র্স’ সেজে দাঁড়িয়ে রয়েছে মানুষ-পুতুল। কোথাও সুদৃশ্য চিনে পোশাকে পরীর মতো মেয়েরা। আবার কোথাও উপস্থিত অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতে হচ্ছে ‘লায়ন ডান্স’। উদ্বোধন উপলক্ষে গান শোনাতে এসেছে ‘চায়না ন্যাশনাল সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা’। আর এসেছেন ‘স্কাই ওয়াকার’ জেড কিন্ডার মার্টিন ও তাঁর স্ত্রী ক্যারিন মাফ্রে।
প্রায় ৫০০ ফুট উঁচুতে দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে স্যান্ডস্ কোটাই ও তার উল্টো দিকের ভেনেশিয়ান ম্যাকাও রিসর্টের মধ্যেকার ১৭০০ ফুট দূরত্ব অতিক্রম করবেন তাঁরা। ১২,০০০ বর্গফুটের ‘প্যারাডাইস গার্ডেন’ সেজে উঠেছে মরসুমি ফুলে। সত্যিই যেন স্বর্গোদ্যান। সেখানেই রয়েছে চিনের খ্যাতনামা ভাস্কর সান জিয়াবিনের হাতে তৈরি ১৬ ফুট লম্বা ও ৫,৫০০ পাউন্ড ওজনের ব্রোঞ্জ ও সোনার তৈরি অতিমানবিক মূর্তি ‘গড অফ ফরচুন’। ভাগ্যকে এক বার যাচাই করে নেওয়ার জন্য রয়েছে নিজস্ব ‘হিমালয়া ক্যাসিনো’।
ভোজনবিলাসী ও কেনাকাটা-বিলাসীদেরও স্বর্গ এই স্যান্ডস্ কোটাই। হোটেলের মধ্যেই রয়েছে প্রায় ৬০০টি দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডের দোকান নিয়ে ‘শপ্স কোটাই সেন্ট্রাল’। সেই সব দোকানে মেলে না এমন কিছুই নেই। আর রয়েছে প্রায় ২০ রকমের চেনা-অচেনা ক্যুইজিনের রেস্তোরাঁ। এগ্জিকিউটিভ শেফ কেন্জি টি সাল্জের কথায়, চিনের নানান প্রদেশের সুস্বাদু সব খাবার আর এশিয়ার রান্নার বৈশিষ্ট্যকে আলাদা আলাদা ভাবে হাজির করাটাই একটা চ্যালেঞ্জ। আর এই সব রেস্তোরাঁর মধ্যে অন্যতম ‘গ্র্যান্ড অরবিট’ এখানকার বৈশিষ্ট্য পর্তুগিজ ঘরানার ম্যাকানিজ রান্না, চিনে খাবার, ব্রাজিল ঘরানার চুরাস্কো, ভারতীয়, তাই ও মালয়েশিয়ান রান্না, এ ছাড়া সুশি ও সাশিমির সম্ভার। রয়েছে ‘ডাইন্যাস্টি এইট’ চিনের কিন, হান, সুই, তাং, সং, ইউয়ান, মিং ও কিং সাম্রাজ্যের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে সাজানো চিনে খাবারের রেস্তোরাঁ।

‘দো মার’ আসল ভূমধ্যসাগরীয় ঘরানার এই রেস্তোরাঁয় মিলবে মধ্য প্রাচ্যের মেজ, স্প্যানিশ পায়েলা, মোরোক্কান ট্যাজিন ও ইতালিয় তিরামিশু, সঙ্গে অঢেল ওয়াইন। এ ছাড়া রয়েছে চিনের ডংবেই ও সিজ্যুয়ান প্রদেশের খাবারের রেস্তোরাঁ ‘নর্থ’, সিঙ্গাপুর-স্পেশ্যাল ‘লাকি এক্সপ্রেস’, রকমারি ভাতের সাম্রাজ্য ‘রাইস এম্পায়ার’ এবং ‘জিন’।

স্যান্ডস্ কোটাই-এ উৎসব অন্তহীন। তবে দিন শেষ হয়। আলোয় আলোয় সেজে ওঠে রূপকথার ম্যাকাও-নগরী। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ভ্রমণপিপাসু মানুষেরা প্রস্তুত হন নৈশবিলাসের জন্য। রাত বাড়লেও ম্যাকাওয়ের চোখে ঘুম নেই। ঝকঝকে হাইওয়ে ধরে গাড়ি ছুটছে সাঁইসাঁই। আর কোটাই স্ট্রিপের আকাশ-ছোঁয়া হাইরাইজের দুনিয়া ঝলমল করছে মায়াবী আলোয়।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.