উত্তর-পূর্ব ভারতে কেন বারংবার জনজাতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথা চাড়া দেয়, তাহা লইয়া চিন্তাবিদ ও রাজনীতিকদের উদ্বেগের অন্ত নাই। কেন এই প্রান্তীয় ভূখণ্ডের জনসাধারণ ভারতীয়তার অখণ্ড কেন্দ্রীয়তায় লীন হইতে দ্বিধাগ্রস্ত? কেন আত্মপরিচয়ের সংকীর্ণ রাজনীতিতে তাঁহারা আটকাইয়া থাকেন? জিজ্ঞাসার সন্ধানী আলোটি নিজেদের দিকে ঘুরাইয়া ধরিলে বোধহয় এ প্রশ্নের সহজতর উত্তর মিলিবে। মূল ভূখণ্ডের ভারতীয়তা কি এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলিকে আপন করিয়া লইতে চাহিয়াছে? পাল্টা এই প্রশ্নটি ঘুরিয়া-ফিরিয়া ওঠে, যখন মূল ভূখণ্ডের প্রতিষ্ঠানগুলিতে উচ্চশিক্ষার জন্য আসা মণিপুরি বা গারো তরুণ-তরুণীরা নির্যাতিত হন কিংবা হয়রানি ও নির্যাতন সহ্য করিতে না পারিয়া আত্মঘাতী হন। মাঝেমধ্যেই দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। এবং কেবল পড়ুয়ারা নন, চাকুরিরতা তরুণ-তরুণীরাও নানা অত্যাচার, ধর্ষণ, এমনকী হত্যাকাণ্ডেরও শিকার হন। সম্প্রতি কর্নাটকে এক মণিপুরি ছাত্রের হত্যা এবং দিল্লিতে এক গারো ছাত্রীর আত্মহত্যা প্রশ্নটিকে আরও প্রাসঙ্গিক করিয়াছে।
ইহা দুর্ভাগ্যজনক সত্য যে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষদের পীত গাত্রবর্ণের জন্য ‘মূল স্রোত’-এর হিন্দুস্তানিরা প্রায়শ তাঁহাদের চিনা বলিয়া ভুল করেন। ভারত-চিন যুদ্ধের পর হইতে চিনাদের প্রতি যে বিরূপতা ভারতীয় জনচিত্তে প্রতিপালিত হইয়াছে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনজাতিগুলিকে তাহার শিকার হইতে হয়, বিশেষত যখন তাঁহারা নিজেদের ভৌগোলিক অবস্থানের নিরাপত্তা ছাড়িয়া উচ্চশিক্ষার্থে কিংবা কার্যব্যপদেশে হিন্দুস্তানে আসিয়া পড়েন। রাস্তায়-ঘাটে টিটকারি, কলেজে বাড়তি র্যাগিং, বাজারে-দোকানে কটূক্তি, হেনস্থা, এমনকী নিগ্রহ এ সবের সহিত উত্তর-পুবের জনজাতিদের নিয়ত ঘর করিতে হয়। সমাজ হইতে এ জন্য তাঁহারা কোনও নিরাপত্তা পান না, আইনরক্ষকরা তাঁহাদের কোনও রক্ষাকবচ দেয় না। তাঁহাদের এই নিরাপত্তাহীনতা ও অসহায়তার সুযোগ লইতে দুষ্কৃতীরা চড়াও হইলে তাই প্রতিকারের সম্ভাবনাই থাকে না। সংকীর্ণ আত্মপরিচয় আঁকড়াইয়া থাকার পরিবর্তে জাতীয় জীবনের মূল ধারায় লীন হইবার জন্য জনজাতীয়দের উদ্দেশে কত না উপদেশ নিয়ত বর্ষিত। অথচ তথাকথিত মূল ধারার জাতীয় জীবন আলিঙ্গন নয়, প্রত্যাখ্যানের ঘৃণাই তাঁহাদের উদ্দেশে ওগরাইয়া দিতেছে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ, পুলিশ, নিরাপত্তাকর্মীরা কি একটু সংবেদনশীল হইতে পারে না?
এক দিকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হওয়ার অপরাধে ভারতীয় রাষ্ট্র প্রান্তিক জনজাতিদের আত্মশাসনের স্পর্ধাকে সামরিক বুটের তলায় দমন করিয়া থাকে। অন্য দিকে মূল স্রোতে শামিল হইতে আসা জনজাতীয়দেরও লাঞ্ছনা-নিগ্রহ করিয়া দূরে সরাইয়া রাখে, ‘অপর’ করিয়া রাখে। এই অপরত্ব জনজাতির মানুষ প্রতিনিয়ত হিন্দুস্তানের প্রতিবেশীদের কাছ হইতে মর্মে-মর্মে উপলব্ধি করিয়া থাকেন। অতঃপর ভারততীর্থে পুণ্যস্নানে নিরত হওয়ার সদিচ্ছা কেমন করিয়া অক্ষত থাকিতে পারে? উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আজও যে শান্তি ফিরিয়া আসে নাই, এখনও যে নাগা, বড়ো, আল্ফা, মণিপুরি ও ত্রিপুরি জনজাতির একাংশ ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের নিশান উড়াইয়া রাখিয়াছে, তাহার কারণ জনজাতীয় সন্ত্রাসে নয়, অন্বেষণ করিতে হইবে জনজাতির প্রতি কেন্দ্রীয় শাসক গোষ্ঠীর নীতি এবং হিন্দুস্তানের আমজনতার বৈরী মানসিকতার মধ্যে। |