পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদ শহরে নিরাপদে লুকাইয়া থাকা আল-কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে খতম করার বর্ষপূর্তিতে কাবুলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হুসেন ওবামার অঘোষিত সফরে পর্যাপ্ত নাটকীয়তা ও প্রতীকী তাৎপর্য ছিল। ছয় ঘণ্টার এই সফরে ওবামা প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের আফগান সরকারের সহিত চুক্তি করিয়া ভবিষ্যৎ মার্কিন-আফগান সম্পর্কের রূপরেখাও রচনা করেন। দীর্ঘমেয়াদি সেই সম্পর্ক যে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর স্বদেশে ফেরার সঙ্গে-সঙ্গেই ছিন্ন হইবে না, সেই আশ্বাসও দেন। তাহার অর্থ যদি হয়, তালিবানের মহড়া লইতে আরও কিছু কাল আফগানিস্তানে থাকিয়া যাওয়া, তবে অবশ্য ওবামার নাটকীয় সফরের প্রতীকী মূল্য কিঞ্চিৎ হ্রাস পায়। দেড় লক্ষাধিক মার্কিন নৌসেনাকে আফগানিস্তানে পরিপোষণ করিতে মার্কিন কোষাগার হইতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় হইতেছে, মার্কিন জনমত তাহাতে বিরূপ হওয়ারই কথা। নির্বাচনের বছরে ওবামার পক্ষে সেটা শুভ নয়।
উত্তরোত্তর শক্তিশালী তালিবানদের মোকাবিলা করার ক্ষমতা কারজাই সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর নাই, মার্কিন ও ন্যাটো প্রশিক্ষণেও সে-ক্ষমতা অর্জিত হওয়ার নয়। কারজাইয়ের শখের পুলিশ ও আধাসেনাদের তালিবানদের হাতে কচুকাটা হওয়ার জন্য ছাড়িয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত ওয়াশিংটনের আফগান অভিযানের যৌক্তিকতা লইয়াই প্রশ্ন তুলিবে। সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ যুগের আধিপত্যকামী বীক্ষা একবিংশ শতকের সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার মধ্যে যে ইতিহাস-অজ্ঞতা রহিয়াছে, মার্কিন প্রশাসন বারংবারই তাহার পরিচয় দিয়াছে। ইরাক তথা মেসোপটেমিয়া ধ্বংস হইয়া গিয়াছে। পশ্চিম এশিয়া ও উপসাগরীয় অঞ্চলে ওয়াশিংটনের তাঁবে মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে স্বৈরাচারীদের বিরুদ্ধে জনরোষ ও গণতান্ত্রিক অভীপ্সার বর্শামুখ মার্কিন স্বার্থের দিকেই নিবদ্ধ। আফগানিস্তানে একদা মার্কিন অর্থ ও অস্ত্রে পুষ্ট মুজাহিদিন যখন তালিবান রূপে আত্মপ্রকাশ করিয়া আল-কায়দাকে আতিথ্য দিয়া ইসলামি সন্ত্রাসবাদের সূতিকাগার হইয়া উঠিল, তখন কাবুল উপত্যকাকে বোমায়-ক্ষেপণাস্ত্রে গুঁড়াইয়া প্রস্তর যুগে ফিরাইয়া দিবার আস্ফালন করিয়া জর্জ ডব্লিউ বুশের বাহিনী মোতায়েন হয়। ওবামা পূর্বসূরির অভিযান আরও সংহত করিয়া তোলেন। এখন ইরাকের মতো সেখান হইতেও পাততাড়ি গোটাইবার তোড়জোড়।
তালিবানরা কী করিবে, ওবামা কাবুলের মাটি ছাড়িয়া যাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আত্মঘাতী ফিদাইন হামলায় তাহা জানাইয়া দিয়াছে। আফগানদের সোভিয়েত-বিরোধী ‘মুক্তিযুদ্ধ’ সমর্থনের নামে মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানের হাত শক্ত করার যে নীতি লইয়াছিল, ইসলামাবাদের সামরিক গোয়েন্দা চক্র (আইএসআই) পাক তালিবানের সহিত গাঁটছড়া বাঁধায় তাহাও সন্ত্রাস দমনের আন্তর্জাতিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে গিয়াছে। এখন তো পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার অলঙ্ঘনীয়তার জাতীয়তাবাদী জিগির তুলিয়া এই অঞ্চলে মার্কিন তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করার দাবি খোদ পাক পার্লামেন্ট হইতেই উঠিতেছে। এই সবই কিন্তু মার্কিন বিদেশনীতি ও সমরনীতির ব্যর্থতাকেই তুলিয়া ধরে। আমেরিকা এখন পালাইতে পারিলে বাঁচে। কিন্তু বৃহৎশক্তির অহমিকা তাহাকে ল্যাজ তুলিয়া পালাইবার প্রশ্নে লজ্জিত, সঙ্কুচিত করিতেছে। ইরাকের মতো আফগানিস্তানেও তাহার নিষ্ক্রমণ ‘সম্মানজনক’ হওয়া চাই। মাঝখান হইতে আফগানিস্তান শ্মশান হইয়া গেল। ইরানের সহিত সংলগ্ন সীমান্তের কারণে কাবুল ওয়াশিংটনের কাছে রণনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যত দীর্ঘ কাল আমেরিকা কাবুলে থাকিবে, ততই দীর্ঘায়িত হইবে আফগান জনসাধারণের দুর্দশা, বাড়িবে দক্ষিণ এশিয়া তথা উপমহাদেশের অস্থিরতা। |