চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
শিল্পীর উপলব্ধি, জীবন মৃত্যুর চেয়েও বড়
ম্প্রতি রেবা হোরের ছবি ও ভাস্কর্য নিয়ে সমৃদ্ধ একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সিগাল ফাউন্ডেশন ফর দ্য আর্টস-এর উদ্যোগে তাদের নিজস্ব গ্যালারিতে। ১৯৪০-এর দশকের বাস্তবতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যাঁরা শিল্পের ক্ষেত্রে এসেছিলেন, রেবা হোর তাঁদের অন্যতম। ১৯৪৬-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক হওয়ার পর ১৯৪৯-এ কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুল থেকে তিনি শিল্পশিক্ষা শেষ করেন। তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী হয়েছিল দিল্লিতে ১৯৬০ সালে। অবশ্য এর আগে ১৯৫৪ সালে কলকাতার চৌরঙ্গী টেরাসে প্রখ্যাত শিল্পরসিক যতীন মজুমদারের পৃষ্ঠপোষকতায় সোমনাথ হোরের সঙ্গে তাঁর একটি যুগ্ম প্রদর্শনী হয়েছিল। ২০০৯-এর ২২ মার্চ তিনি প্রয়াত হন। প্রয়াণের পর জনসমক্ষে এটিই তাঁর শিল্পের প্রথম উপস্থাপনা। প্রায় ৬৮টি ছবি ও ১৭টি ভাস্কর্য নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনী পূর্বাপর চরিত্রের না হলেও শিল্পীর আঙ্গিক ও মননের প্রায় পূর্ণ পরিচয় উঠে আসে এই উপস্থাপনা থেকে।
এই উপলক্ষে এ দিন একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে। শিরোনাম- ‘রেবা হোর: মাই স্টোরি দিজ অ্যান্ড দ্যাট’। প্রদর্শিত ছবি ভাস্কর্য ছাড়াও এতে রয়েছে শিল্পীর একটি দীর্ঘ আত্মজীবনীমূলক লেখা। তা থেকে উঠে আসে তাঁর সত্তার বিকাশের একটি রূপরেখা। সেখানে এক জায়গায় তিনি তাঁর নিজের সৃজন প্রক্রিয়া সম্বন্ধে যা বলেছেন, তা অনেকটা এ রকম: ব্যক্তি হিসেবে তিনি নিজের অনুভূতির উপর নির্ভর করেন। নিজেকে তিনি বলেছেন ‘ইমোশনাল’। অনেকটাই স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে তাঁর রচনায়। একটা ভাবনা থাকে, একটা ‘থিম’ থাকে। সেটা উঠে আসে যা তিনি চারপাশে দেখেন, যা তাঁকে নাড়া দেয়, তা থেকে। বর্ণ বা ‘কালার মাস’-এর ব্যবহারে সেই ভাবনা আকার পায়। তুলির টানের গতিময়তায় পরিস্ফুট হয়ে ওঠে রূপ। এ থেকে বোঝা যায়, স্বতঃস্ফূর্ততা তাঁর সৃজনের একটি বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতি বা মানুষের অবয়বকে অভিব্যক্তিবাদী রীতিতে ভেঙে বা বিশ্লিষ্ট করে তিনি চিত্রপটে উপস্থাপিত করেন। আনন্দ ও বিষাদের সংশ্লেষ ঘটে। দুঃখের আঁধারের ভিতর থেকে আলো নিষ্কাশিত হতে থাকে।
শিল্পী: রেবা হোর
১৯৯৬ সালে ‘সিগাল’-এর উদ্যোগেই কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাঁর একক প্রদর্শনী। সেই প্রদর্শনীর স্মারকপত্রে ভূমিকা-স্বরূপ লেখায় তিনি বলেছিলেন জীবন মৃত্যুর চেয়ে বড়। জীবনে দুঃখ আছে, ধ্বংস আছে, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন না এ ভাবেই সব কিছু শেষ হবে। তিনি বিশ্বাস করতে চান, এ সব কিছুর ভিতর থেকে সুন্দর উঠে আসে। এবং দুঃখ ও আঘাত সত্ত্বেও সকলেরই বাঁচার জন্য কোনও বৃহত্তর অবলম্বন থাকে। এই আশাবাদ, এই বিশ্বাস, এই মানবতাবোধ তাঁর সৃজনের বৈশিষ্ট্য।
তাঁর ছবিতে অবয়ব থাকে। অবয়বের সঙ্গে অবয়বের পারস্পরিক সম্পর্ক থাকে। কিন্তু কোনও আখ্যান থাকে না। চিত্রীয় পরিসরের সঙ্গে অবয়ব সংস্থাপনের অন্তর্লীন সম্পর্ক ও সংঘাত থেকে গড়ে ওঠে একটি নান্দনিক আবহ। সেটি বিশুদ্ধ চিত্রধর্মী। এ ভাবেই জীবনের অন্তর্লীন সুরকে তিনি দৃশ্যতার ভাষায় রূপান্তরিত করেন। এই প্রদর্শনীতে রয়েছে কিছু ফুলের ছবি। কাগজের উপর প্যাস্টেলে আঁকা। ফুলের অনুপুঙ্খ বর্ণনা নেই। পুঞ্জিত রেখা ও ছায়াতপের সমন্বয়ে এবং বিভিন্ন বর্ণক্রমের পারস্পরিক টানাপোড়েনে ফুলের গঠনের মূলগত বৈশিষ্ট্যকে তিনি তুলে এনেছেন। যা অনেকটা গাঠনিক বা স্ট্রাকচারাল। এটা তাঁর রচনার একটি বৈশিষ্ট্য। জলরং ও প্যাস্টেলে আঁকা ‘ফ্রুট সেলার’ ছবিতে একটি মানুষের কাঁধ থেকে মুখ পর্যন্ত দীর্ঘায়ত উপস্থাপনা। মাথার উপর ঝুড়িতে রয়েছে ফলের সম্ভার। এ রকম প্রতিমা বিন্যাসের ভিতর থেকে শিল্পী বের করে আনতে চেয়েছেন এক জন কর্মী মানুষের সত্তাকে। তেলরঙে আঁকা ‘উওম্যান উইথ চিলড্রেন’ ছবিতে মা ও শিশুর প্রতিমাকে ঘিরে তিনি যে চিত্রীয় পরিসর সৃষ্টি করেন, তাতেই রচনাটি নান্দনিক তাৎপর্য পায়।
টেরাকোটা ভাস্কর্যগুলিতে মানুষের মুখের উপস্থাপনাই বেশি। সেই মুখের নির্মাণে আদিমতার অভিব্যক্তি প্রাধান্য পায়। অমসৃণ বুনোট ও সংক্ষুব্ধ অভিব্যক্তির ভিতর দিয়ে অন্তর্লোকের তমসা উদ্ভাসিত হতে থাকে। সেই তমসারই ভিতর থেকে শিল্পী বের করে আনেন আলোর ইশারা। আদিমতাকে এ ভাবে আধুনিকতায় নন্দিত করে তোলা, তাঁর ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্য। ১৯৪০-এর দশকের সামাজিক সংঘাত থেকে মানবিক মূল্যবোধকে বের করে এনে যে সব শিল্পী আধুনিকতাবাদী প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, তাঁদের মধ্যে মহিলাশিল্পীর সংখ্যা খুবই সীমিত। রেবা হোর আধুনিকতাবাদের সঙ্গে মানবীচেতনার সমন্বয় ঘটিয়েছেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.