রাস্তার পাশের খাল থেকে জল তুলছিল এক কিশোরী।
নাম কি?
‘ঝুমা, ঝুমা সরকার।’
বেলা চড়ছে। নিউ পি অ্যান্ড টি পাড়ার খাল থেকে জল তুলে বালতিতে ভরছিল মেয়েটি। “পুরসভার পানীয় জলের কল বন্ধ বহু দিন। কোনও রকমে মাটির নীচের পাইপ থেকে জল তুলেই দিন চলছে” জানায় ঝুমা।
এটা নমুনা মাত্র। গোটা ৩১ নম্বর ওয়ার্ড জুড়েই ছড়িয়ে জলকষ্টের হরেক গল্প। এমনকী সিপিএম কাউন্সিলর সীমা দাসও মানতে বাধ্য হন, জলসমস্যার অভিযোগ ‘আংশিক সত্য’। তবে তাঁর দাবি, এলাকায় ১০টি কুয়ো আছে। আরও ৮টি কুয়ো নির্মাণের কাজ চলছে। সেগুলি সম্পূর্ণ হলেই সমস্যা অনেকটা মিটে যাবে।
কালীপুর গ্রাম, ভবানীপল্লি, বিশ্বনাথপল্লি, মানসপল্লি, ‘এলবি’ টাইপ, ‘জিএন’ টাইপ, লেবারহাট বস্তি, শালবাগান, ডিভিসি মোড়, ভগৎ সিংহ কলোনি নিয়ে ৩১ নম্বর। রাস্তা, নিকাশি, পানীয় জল নিয়ে অভিযোগ প্রচুর। স্থানীয় তৃণমূল কর্মী ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগ, বস্তি এলাকায় পর্যাপ্ত কমিউনিটি শৌচাগার নেই। আবর্জনা নিয়মিত সাফ হয় না। অলিগলিতে পর্যাপ্ত আলো নেই। নিউ পি অ্যান্ড টি পাড়ার বাসিন্দা সঙ্গীতা বাল্মিকী বলেন, “এলাকার নিকাশি বেহাল। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তার জল ঢুকে যায় বাড়ির ভিতরে।”
প্রাক্তন শাসকদলের যুবনেত্রী সীমাদেবী অবশ্য ‘কাজের’ লম্বা তালিকা দিয়েছেন
১) পাঁচশো মিটার কংক্রিটের রাস্তা করা হয়েছে লেবারহাট থেকে বিসি রায় রোড পর্যন্ত, সঙ্গে পাকা নর্দমা।
২) ‘এলবি’ টাইপ থেকে নুনিয়াপাড়া পর্যন্ত চারশো মিটার কংক্রিটের রাস্তা তৈরি করা হয়েছে।
৩) আদিবাসী পাড়া, ভবানীপল্লি, রেল কলোনি বস্তি, মসজিদ পাড়াতেও নতুন নতুন রাস্তা হয়েছে।
৪) ভগৎ সিংহ কলোনিতে রাস্তা ও নর্দমার কাজ ১০০% সম্পূর্ণ।
৫) বিশ্বনাথপল্লি, কালীপুর এলাকায় নতুন নর্দমা গড়া ও সংস্কার হয়েছে।
৬) কালীপুর গ্রামে আলোর ব্যবস্থা এবং বিএসইউপি-র ৫টি বাড়ি হয়েছে।
৭) মুক্তদল ক্লাবে মহিলা খেলোয়াড়দের জন্য শৌচাগার-সহ বিশেষ ঘর করে দেওয়া হয়েছে।
৮) স্থানীয় শিশুশ্রমিক স্কুলের পাকা বাড়ি ও রান্নাঘর নির্মাণের কাজ চলছে।
৯) চলছে এসবিএসটিসি গ্যারাজ মোড়ে দু’টি কমিউনিটি শৌচাগার নির্মাণের কাজও।
১০) অন্তত ১০০ জন বার্ধক্য ভাতা, ৬০ জন বিধবা ভাতা এবং ২০ জন প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন।
বিরোধীদের অভিযোগ, তিন রকম ভাতা দেওয়া ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রে স্বজনপোষণ করেছেন কাউন্সিলর। সীমাদেবী অবশ্য তা উড়িয়ে দিয়েছেন। |
|
|
৩১ নম্বরে খাবার জল নিতে হয় এ ভাবেই। |
৩২ নম্বরে নব ওয়ারিয়ার নর্দমা। |
|
যেমন এলাকার একাংশে বিদ্যুৎ না থাকার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম কাউন্সিলর বুধন মণ্ডল। মূলত তিনটি প্রাচীন গ্রাম নব ওয়ারিয়া, পিয়ালা ও পলাশডিহা নিয়ে তাঁর ওয়ার্ড। বুধনবাবুর দাবি, এলাকার চারটি বড় পুকুরের মধ্যে তিনটির সংস্কার হয়েছে। অন্যটির সংস্কার কাজ চলছে। বিএসইউপি প্রকল্পে দুঃস্থেরা ৮০টি বাড়ি পেয়েছেন। বার্ধক্যভাতা পেয়েছেন ৭৫ জন, বিধবা ভাতা ৬৮ জন, প্রতিবন্ধী ভাতা ৩ জন। ৬টি কমিউনিটি শৌচাগার নির্মাণের কাজ চলছে। পিয়ালায় একটি খেলার মাঠের সীমানা পাঁচিল হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী রঘুনাথ মুর্মু মাঠে তারের ‘ফেন্সিং’ দেওয়া হয়েছে। দু’টি শিশু উদ্যান হয়েছে। একটি করে সাংস্কৃতিক মঞ্চ গড়া হয়েছে তিনটি গ্রামেই।
কিন্তু ৩২ নম্বরের দুঃখটা অন্য জায়গায়। জাতীয় সড়কের এক পাশে এই ওয়ার্ড, ঠিক উল্টো দিকে শহরের অন্যতম অভিজাত এলাকা ঝাঁ চকচকে সিটি সেন্টার। দিন দিন সিটি সেন্টারের ঝকমকানি বেড়ে চলেছে। তার ছিটেফোঁটাও পৌঁছয়নি এ দিকে। যদিও সিটি সেন্টারে আর স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় এখন রাস্তা টপকে নানা প্রকল্প পলাশডিহায় আসছে। গড়ে উঠেছে আইটি হাব, আরবান হাট, একাধিক বেসরকারি কলেজ। পুরসভার উদ্যোগে তিন গ্রামের সংযোগকারী প্রায় দেড় কিলোমিটার পিচরাস্তা হয়েছে।
কিন্তু তা কি যথেষ্ট?
কাউন্সিলর যতই ফিরিস্তি দিন, ওয়ার্ডের মানুষ ‘উন্নয়ন’ মাপছেন ও পারের নিরিখেই। স্থানীয় বাসিন্দা অরজিৎ ঘোষ যেমন আক্ষেপ করেন, “সন্ধ্যা নামলেই সিটি সেন্টার নিয়নের আলোয় ভরে ওঠে। আর আমাদের এ দিকে টিমটিমে বাতি। তাও সংখ্যায় যথেষ্ট নয়।” এলাকার অমর ঘোষ, সৌমেন ধারাদের ক্ষোভ, “জাতীয় সড়কের ও পারে বাড়ি-বাড়ি বর্জ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা রেখেছে পুরসভা। অথচ আমাদের এখানে আঁস্তাকুড়ও নেই। স্থানীয় তৃণমূল নেতা চন্দন ঘোষের অভিযোগ, “নব ওয়ারিয়ায় মূল নর্দমা আগাছায় ভরে গিয়েছে। পিয়ালা সংলগ্ন জামাই কলোনিতে বিদ্যুৎ নেই। পানীয় জল নেই। বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা পান না অনেকেই।” বুধনবাবুর জবাব, “পাঁচ বছর আগের সঙ্গে এখনকার তুলনা করলেই বোঝা যাবে, প্রকৃত সত্যটা কী!”
বুধনবাবুর একটা সুবিধা আছে। এ বার আর তিনি প্রার্থী নন। তাঁর কাজের দায় বইতে হবে নতুন প্রার্থীকে।
সীমাদেবীর কিন্তু সেই সুবিধাটা নেই। তাতে তিনি খুশি নিশ্চয়ই!
তবে চিন্তা একটাই ‘স্বজন’ শেষে দুর্জন হয়ে না দাঁড়ায়... |
নজরে নগর |
ওয়ার্ড ৩১ |
ওয়ার্ড ৩২ |
• পানীয় জলের সমস্যা রয়েছে
• নর্দমা তৈরিতে অনিয়মের অভিযোগ
• বিধবা ও বার্ধক্য ভাতা দিতে ‘দুর্নীতি’ |
• এলাকায় পুরসভার আঁস্তাকুড় নেই
• জামাই কলোনিতে বিদ্যুৎ-জল অমিল
• মূল নর্দমা ভরে গিয়েছে আগাছায় |
আমি যথাসাধ্য কাজ করেছি,
সরকারি নিয়ম মেনেই করেছি।
সীমা দাস,সিপিএম কাউন্সিলর |
প্রতিটি পাড়ায় বিদ্যুৎ এসেছে,
সংস্কার করা হয়েছে পুকুর।
বুধন মণ্ডল, সিপিএম কাউন্সিলর |
সরকারি ভাতার ক্ষেত্রে
ব্যাপক স্বজনপোষণ।
ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়, তৃণমূল কর্মী |
বিদ্যুৎ নেই, জল নেই,
ভাতা পান না অনেকেই।
চন্দন ঘোষ, তৃণমূল নেতা |
|