|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
মানুষের সঙ্গে উঁকি দেয় সমাজ ও ইতিহাস |
যাঁর হাতে বাংলা ছোটগল্পের মানচিত্র ক্রমশই বর্ণময় হয়ে উঠেছে, সেই হাসান আজিজুল হক তাঁর আত্মকথায় তুলে এনেছেন নিজের জীবনের সঙ্গে জড়ানো উপাখ্যানগুলি ফিরে যাই ফিরে আসি (দে’জ, ২০০.০০)। দুই পর্বে বিন্যস্ত এই স্মৃতির আখ্যানে মানুষের সঙ্গে উঁকি দিয়ে যায় সময় ও ইতিহাস। ব্যষ্টি ও সমষ্টির নিরন্তর যাতায়াতে কোথায় পৌঁছতে চাইছেন, শুরুতেই জানিয়েছেন লেখক: ‘চেতনা-আত্মচেতনার মাঝখানের সান্ধ্য জায়গাটায় অনেকবার ফিরে যেতে চেয়েছি। সে যেন শুধু চাঁদের আলোই নয়, স্বপ্নের চাঁদের আলো। কোনো কিছুই ঠিকমতো ঠাহর হয় না। বস্তু বস্তুর চেহারা ত্যাগ করে, ভয় মূর্ত চেহারায় সামনে এসে দাঁড়ায়, কল্পনাও বস্তু হয়ে ওঠে।
বিনোদ ঘোষালের গল্প জীবনযাপনের ভিতর থেকে উঠে আসা নানান মূহূর্তকে যেন ভিন্ন ভাবনার স্রোতে টেনে নিয়ে যায়। নতুন শতকে নবীন যে কথাকারেরা লিখছেন, তাঁদের মধ্যে বিনোদ সাহসী, প্রচলিত গদ্যের বাইরে বেরিয়ে এসে বিষয়-আঙ্গিককে টেনে নিয়ে যান নতুন নতুন নিরীক্ষায়। তাঁর গল্পগ্রন্থ ডানাওলা মানুষ (পরশ পাথর, ১০০.০০) থেকে একটি গল্পের উদাহরণ তুলছি: ‘অজস্র ডানাওলা পরি ভিড় করত আমার কাছে। কিন্তু তাদের শরীরে সব নকল ফুলের গন্ধ। ওদের খোলা গায়ে প্রাণপণে নাক ঘষে আমি এতটুকু ঘাসের গন্ধ পেতাম না। দূর করে দিতাম ওদের ক্রোধে। আবার ডাকতাম, আবার তাড়িয়ে দিতাম ঘৃণায়। আর এর মধ্যেই চুপিসারে বয়েস কখন হুড়মুড় করে ঝুঁকতে শুরু করেছিল আমার দিকে।’
মৃত্যুঞ্জয় সেনের গল্পগ্রন্থ সমুদ্রের জলে (লোকসখা, ১৫০.০০) পড়তে-পড়তে টের পাওয়া যায় তিনি কবি। তাঁর নিরীক্ষায় বা আঙ্গিকে গল্পের চরিত্রগুলি হয়ে ওঠে অন্তর্গূঢ় রহস্যলোকের। যেমন ধরা যাক নামগল্পটিকেই: ‘অন্ধকার তখন আরও গাঢ় হয়েছে। দূরের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড জলাশয়গুলো আকাশের গায়ে মিশে আছে। জলাশয়ের জলেই জলরঙ আলো। আলোগুলো চকচকে চোখের মতো।’
সুন্দরবনের ভূমিপুত্র উৎপলেন্দু মণ্ডলের উপন্যাস সেতু (বইওয়ালা, ৭৫.০০)। সুন্দরবনের দ্বীপময় জীবনের এক কালখণ্ডের ছবি। জীবিত-অর্ধজীবিত-নিরুদ্দিষ্ট মানুষের কাহিনি। উন্নয়নের পরিকাঠামোকে পিছনে ফেলে এ-কাহিনি মহাকালের অংশ হয়ে ওঠে।
পশ্চিম আকাশ থেকে আসা আলোর মুখোমুখি হল রেখা। হাল্কা হলুদের গুঁড়োয় নরম হয়ে গেছে আলোর তাপ। কনে-দেখা-আলো। সারাদিনের শেষে একটুখানির জন্য ফুটে ওঠে। তারপরই অন্ধকার এসে নিঃশেষ করে দেয়। চোখের পাতা কাঁপছে রেখার। দু চোখ ভরে দেখে নিচ্ছে সে কেমন করে একটা দিন তার স্বপ্নের সঞ্চয় নিয়ে এগিয়ে চলেছে রাত্রির আয়োজনে। মতি নন্দীর এ-গল্পটির নাম ‘ছাদ’, এখনও অগ্রন্থিত। এতদিনে তাঁর ছোটগল্প সমগ্র (সম্পা: মানস চক্রবর্তী। দীপ প্রকাশন, ৩২৫.০০) বেরল। এই অসামান্য গদ্যশিল্পী কী ভাবে জীবনকে দেখতেন তার আন্দাজ যেমন গোটা বই জুড়েই পাঠক পাবেন তাঁর গল্পগুলিতে, তেমনই তাঁর মননের বা ভাবনার জগতেরও একটা হদিশ পাবেন বইয়ের শুরুতেই, লেখকের ‘দ্বাদশব্যক্তি’ রচনাটিতে: ‘ভিতরের প্রতিবন্ধকতা? লেখকের বড় শত্রু সে নিজে। বহু গূঢ় কথা বলার থাকে যা শুধু ভেবেই যাই কিন্তু লিখতে পারি না। চেতনার কোথায় যেন একটা সেন্সর ব্যবস্থা রয়ে গেছে যা দেহ ও মনের তীব্র ইচ্ছা বা ক্রিয়া কল্পনাকে ছেঁকে নেয়, বহু সত্য প্রকাশে বাধা দেয়, লেখার হাত চেপে ধরে।... ক্যাচ ধরার জন্য আকাশচুম্বী বলের নিচে দাঁড়ানো ফিল্ডারের মতো তখন অসহায় নিঃসঙ্গ বোধ করি। আমি জানি, একাকীই আমাকে অভ্যন্তরের প্রতিবন্ধকতা ভাঙতে হবে।’
ভূমিপুত্র অধ্যুষিত জন্মভিটা সুবর্ণরেখার নদীতীর থেকে উঠে আসা ঔপন্যাসিক নলিনী বেরার নতুন উপন্যাস দালানের পায়রাগুলি (পরম্পরা, ১০০.০০)। আক্রান্ত স্বদেশ, জন্মভূমি, পরিবার নিয়ে লেখা এ-উপন্যাসে এমন এক দুঃসময়ের ছবি, যেখানে শাল-মহুয়ার পাতায়, ঘাসের চাপড়ায়, পাথরের চাঙে লেগে থাকে ছিট্ ছিট্ রক্তের দাগ। নিসর্গের আবহে তেমনই এক মুহূর্ত তৈরি করেন লেখক: ‘পশ্চিম আকাশে মেঘের সমারোহ, কালো কালো মোষের পারা উঠে আসছে পশ্চিমের মূলাধার থেকে! ভয়ে ভয়ে রৌদ্রের তেজ কখন গুটিয়ে নিয়েছে তার দাপটটুকু!’
অরিন্দম বসুর উপন্যাস অমল গুপ্তর গুপ্তজীবন (গাঙচিল, ১৭৫.০০) এমন একজন লেখককে নিয়ে যিনি নিজেকে বার বার বদলে নিয়ে একই জীবনের মধ্যে স্বাদ পেতে চান বহু জীবনের, যাঁর রোজকার যাপনের ভিতরে বোধ, মেধা, দর্শন ও অনুভূতি দিয়ে বুনে চলেন তাঁর লেখার আশ্চর্য জগৎ ‘হাঁটতে হাঁটতে ক্লাইভ হাউসের সামনে পৌঁছে গেল অমল। উঁচু ঢিপির ওপর গোটা বাড়িটা দিনের বেলাতেও ভুতুড়ে লাগে। অথচ ভেতরে বেশ কয়েকটা রিফিউজি ফ্যামিলি থাকে। আগে বার কয়েক দেখেছে অমল। ভেতরে যায়নি কখনও। সামনের দিকে বিশাল থাম জড়িয়ে আগাছা। বাঁ দিকটা একেবারে ভেঙে পড়েছে। প্রকাণ্ড সব দরজা-জানলা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।... দেওয়ালে বট-অশ্বত্থের ঝুরি ফাটলে ঢুকে গেছে।’
বাংলা গল্প-উপন্যাসে বিবিধের এই সমাবেশ ঋদ্ধ করবে পাঠককে। এত রকমের মানুষ, এত রকমের নিসর্গ, এত রকমের সামাজিক সংকট এই বঙ্গদেশের মানচিত্রকে ক্রমশই যেন প্রসারিত করে দেয়। প্রয়াত মতি নন্দী থেকে নবীন বিনোদ ঘোষাল অবধি কমবেশি শক্তিশালী প্রত্যেক কথাকারই বিষয় বা আঙ্গিকের দিক থেকে রীতিমত স্বতন্ত্র। এতে বৈচিত্র বাড়ে, আরও বেশি মনের খোরাক তৈরি হয় পাঠকের জন্যে। |
|
|
|
|
|