পুস্তক পরিচয় ১...
দ্য পলিটিকাল ইজ পার্সোনাল
টিলা, অসীম চট্টরাজ। সপ্তর্ষি প্রকাশন, ২০০.০০
ই লেখার শিরোনামটি বাংলা করলাম না এই কারণে যে এটা একটা বিখ্যাত স্লোগানের অনুসরণে লেখা। নারীবাদী আন্দোলন আমাদের বলেছিল: দ্য পার্সোনাল ইজ পলিটিকাল। এই স্লোগানটির অনুভব ছিল যুগান্তকারী। এই স্লোগান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল, নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সম্পর্কের যে অসাম্য ঘটে তাকে আসলে আমাদের রাজনৈতিক বিষয় বলে দেখতে হবে, ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে এড়িয়ে গেলে চলবে না।
চার পাশে বেশ কিছু রাজনৈতিক মানুষকে বহু বছর ধরে দেখে আসার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়, এই কথাটাকে যদি একটু উল্টে দেখি অর্থাৎ, দ্য পলিটিকাল ইজ পার্সোনাল, সেটাও কিন্তু ঠিক। বৃহত্তর রাজনৈতিক ঘটনাবলি কী ভাবে ব্যক্তিজীবনকে রক্তাক্ত করে, উদ্দীপ্ত করে, হতাশ করে, বাঁচায়, মারে সেটা আমরা অনেকেই হয়তো দেখেছি। আমরা দেখেছি স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধজয়ের আখ্যান কী ভাবে কুরুক্ষেত্রে ন্যায়ের বিজয়ের কাহিনির মতনই গ্লোবাল মহাকাব্য হয়ে ওঠে, দেখেছি ষাটের দশকে তরাইয়ে কৃষক আন্দোলনে বামপন্থী সরকারের পুলিশ গুলি চালানোর পর কিছু বামপন্থী মানুষের বুকের ভেতর কী ভাবে রক্তক্ষরণ ঘটে, সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর কেমন বহু জীবনে শূন্যতা নেমে আসে, চিন বিশ্ববাজারে অংশগ্রহণকেই ‘সমাজতান্ত্রিক’ বিকাশের পথ বলে বেছে নেওয়ায় কত বিশ্বাসী মানুষ হন বিপন্ন। কত দাম্পত্যে চিড় ধরিয়েছে রাজনীতি, কত মা-বাপকে করে তুলেছে সন্তানের সামনে অসহায়, কত বন্ধুত্ব টুকরো হয়ে গিয়েছে, কত জীবন গিয়ে দাঁড়িয়েছে খাদের ধারে।
শিল্প শহর দুর্গাপুরের রাজনৈতিক পটভূমিকায় লেখা উপন্যাস টিলা আমাদের আবার এই জীবনগুলোর সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। উপন্যাসটিতে দুর্গাপুর নেহাতই একটা স্থান, সেটা টিটাগড় বা হাওড়া যে কোনও জায়গাই হতে পারত। সময়কালের দিক থেকে উপন্যাসটি গত দশকের মধ্যেই অবস্থিত। কিন্তু বিন্দুতে সিন্ধু দেখানোর মতো করে ঔপন্যাসিক অসীম চট্টরাজ আমাদের সামনে এই দীর্ঘতর ইতিহাসের প্রেক্ষিতটিকে তুলে ধরেছেন।
২০১১ সাল এই রাজ্যের বাম আন্দোলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ যতিচিহ্ন। গত শতকের গোড়ার দিক থেকে যে মতবাদ ধীরে ধীরে ছড়াতে থাকে তারই একটা সংগঠিত অংশ নানান গণ আন্দোলনের ঢেউয়ে চেপে ষাট ও সত্তরের দশক ধরে শক্তি বাড়ায়, ক্ষমতায় আসে এবং ৩৪ বছর ধরে ক্ষমতায় থেকে যায়। অবশেষে ২০১১-য় তার অন্তত আপাত ক্ষমতাচ্যুতি হয়েছে। এই বাম আন্দোলন বাংলার জীবনে নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত যদি সংখ্যার দিক থেকে দেখি তবে দেখব একটা বিশাল সংখ্যক মানুষ ৩৪ বছর ধরে এই জমানাকে সমর্থন করে এসেছেন। ২০১১-য় যে পরিবর্তন এল তার একটা বড় কারণ কিন্তু এই যে মানুষের মনে হল এই বামেরা এক ধরণের বাম-গণতান্ত্রিক আদর্শ থেকে সরে এসেছে। এই সময়কার বিরোধী রাজনীতি পরিবর্তনকামী যে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জোট তৈরি করল, তার ভাষাও কিন্তু এক অর্থে বাম-ঘেঁষাই ছিল। পরিবর্তনকামী প্রচারে আমরা দেখেছি কী ভাবে গণনাট্য সংঘের সময়কার গান বার বার ব্যবহার হয়েছে, সেই গান ব্যবহারের অধিকার যেন ক্ষমতাসীন বামপন্থার কাছ থেকে সরে গিয়েছিল।
প্রশ্ন হল এই দীর্ঘ সময় ধরে যদি ক্ষমতাসীন বামেরা ধীরে ধীরে বামপন্থা থেকে সরে গিয়ে থাকে, তবে কী ভাবে জীবনের মানে খুঁজছিলেন, তার আশেপাশের মানুষেরা? সেই নেতারা যাঁরা এক দিন সমাজ বদলের স্বপ্ন নিয়ে দলে এসেছিলেন? সবাই তো অকৃতদার হোলটাইমার জ্যাঠামশাই হিসেবে ভাইপোকে সরকারি বরাত পাইয়ে দেওয়াটাকেই ‘উইন্টার প্যালেস’ দখলের পুরস্কার হিসেবে ধরে নেননি। কোন আনন্দ, কোন যন্ত্রণা, কোন হতাশা, কোন সমঝোতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁরা? যদি কোনও সৎ মানুষের মনে দলের রাজনৈতিক আদর্শ নিয়েই প্রশ্ন ওঠে, যদি সে তার আদর্শটাকে মন্ত্রের মতো ব্যবহার করে ‘প্রণামী’ আর ‘দেবোত্তর’ সম্পত্তি গোছানোয় উদ্যোগী হতে না চায়, তবে কেমন হয় তার জীবন? কেমন করে একজন বিশ্বাসী আর এক জন প্রোমোটার ভাগ করে এক লোকাল কমিটির অফিস? কী হয় সেই যন্ত্রণা আর মন্ত্রণার চরিত্র?
টিলা উপন্যাসটির আসল গুণ এই যে এই উপন্যাসটি রাজনীতি নিয়ে হলেও রাজনৈতিক কচকচি নয়, মানুষ নিয়ে। তাই এখানে আমরা দেখি বিধবা মেয়ে দিপুকে। রাজনৈতিক দলের সমর্থক বা কর্মী হয়েও মেয়ে হিসেবে যে খানিকটা বৃত্তের বাইরেই থেকে যায়। আমরা দেখি দিপু আর তার শাশুড়ির আশ্চর্য সম্পর্ক, এই সম্পর্কটা এই উপন্যাসের কেন্দ্রে না থেকেও মনে দাগ কেটে যায়। আমরা দেখি শাশুড়ি আর বউ দুই বিধবার ঘটা করে নিরামিষ রান্নার ধুমের মধ্যে দিয়ে ইন্দ্রিয়-উল্লাসের উদ্যাপন। তাদের মধ্যে ফারাক অনেক, এক জন শহুরে, এক জন গ্রাম্য। শাশুড়ির ভয়, শহরে থাকা চাকুরে বউ যদি আবার বিয়ে করে তবে তাঁর নিজের অসহায়ত্ব বাড়বে কিনা। এই নিয়ে টেনশনও কম নয়, কিন্তু কোথাও আবার ওই নিরামিষের সামাজিক বিধান এই দুই মহিলার মধ্যে একটা যোগসূত্র তৈরি করে, এ-ও এক রাজনৈতিক যুক্তফ্রন্টের প্ল্যাটফর্ম, কিন্তু প্রথাগত রাজনীতিতে এই বোধ অনুপস্থিত।
এই গল্পে আমরা পাই সুরেশবাবুকে। গত কয়েক দশকের পশ্চিমবঙ্গে হয়তো চেনা চরিত্র। দলের সঙ্গে অনেক মতানৈক্য থাকলেও এক আদর্শের ধারণায় বা তাড়নায় তিনি দল ছাড়েননি। কিন্তু উঠতি নেতাদের চোখে তিনি একটা ফেলে আসা যুগের ফসিল। দলে যখন ‘ও সব আদসস *** লাভ নেই’ গোছের ‘মতাদসসের’ আপওয়ার্ড মোবিলিটির যুগ, তখন এই নেতারা আস্তে আস্তে নীরব দর্শক হয়ে ওঠেন। দলের এই পদস্খলনের জন্য চারপাশে বিশ্বাসী মানুষেরা এঁদের ওপরেই অভিমান করেন কিন্তু ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি’তে রথের রশি তো এঁদের হাতে থাকে না।
এই ধরণের নানান জীবনের গল্পের মধ্যে দিয়ে উপন্যাসটি আমাদের জন্য ছুঁয়ে যায় অনেক বড় বড় কিছু প্রশ্ন। আদর্শ আর ক্ষমতার মধ্যে দ্বন্দ্ব কী কোনও সমাজতান্ত্রিক দল কখনও ঠিক ভাবে সামলে উঠতে পেরেছে? যদি না পেরে থাকে তবে একে কী এক একটি সংগঠনের সাময়িক বিচ্যুতি বলে বারবার চালিয়ে দেওয়া যায়? নাকি সংগঠনের ধারণা, ক্ষমতা দখলের পদ্ধতির ধারণা, দল বা রাষ্ট্র চালনার যে সমাজতান্ত্রিক ছক মোটামুটি ভাবে সোভিয়েত রাশিয়ায় তৈরি হয়েছিল, এবং আমাদের দেশে অনুসৃত হয়ে চলেছে, তার ভেতরেই কোনও সমস্যা থেকে গিয়েছে, যে সমস্যা কোনও পার্টি কংগ্রেসে কখনও আলোচিত হয় না।
কিছু কিছু বুকের ভেতরে থেকে যায় কষ্ট। তাই টিলা এক জরুরি উপন্যাস।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.