বৃহস্পতিবার রাত ন’টা। প্রাইভেট টিউশন থেকে জ্যাঠতুতো দাদার সাইকেলে চেপে বাড়ি ফিরছিল পঞ্চম শ্রেণির অনুষ্কা দাস। বারাসতের হেলাবটতলার কাছে আসতেই একটি গাড়ি পথ আটকায়। মেয়েটিকে তুলে চম্পট দেয় দুষ্কৃতীরা।
শুক্রবার সকাল ছ’টা। বারাসত হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে পড়েছিল বছর দশেকের মেয়েটি। সামনে ভিড় করে জনা বিশেক কৌতূহলী লোক। এর মধ্যে এসে পড়লেন আরও কয়েক জন। তাদেরই এক জন শিশুটিকে দেখে বললেন, “এই তো আমাদের অনুষ্কা!” মেয়েকে কোলে তুলে কেঁদে ফেললেন বাবা।
বারাসতে রাজীব-হত্যার ঘটনা সবে এক বছরের পুরনো হয়েছে। দিদি রিঙ্কুর সামনেই ভাই রাজীবকে খুন করেছিল মদ্যপেরা। এ দিনই মুক্তি পেয়েছে ওই ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত ছবি ‘আটটা আট-এর বনগাঁ লোকাল’। তার ঠিক আগের রাতে সেই বারাসতেই দাদার কাছ থেকে বোনকে ছিনিয়ে নিল দুষ্কৃতীরা। শুক্রবার মুক্তিপণ দিয়ে মেয়েকে ফিরে পেয়েছেন বাবা-মা। ঘটনাটা শুনে রাজীবের দিদি, রিঙ্কু বলছেন, “আমাদের ঘটনা নিয়ে তৈরি সিনেমা যে দিন মুক্তি পাচ্ছে, তার কয়েক ঘণ্টা আগেও একটা বাচ্চা মেয়েকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে দুষ্কৃতীরা। বারাসতের পরিস্থিতি বদলায়নি। আমি এখনও বাড়ি থেকে বেরোতে ভয় পাই!”
২০১১-র ১৪ ফেব্রুয়ারি রাজীব-হত্যার ঘটনাটা ঘটেছিল বারাসতের আদালত চত্বরের কাছে। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ লোকাল ট্রেন থেকে বারাসত স্টেশনে নামার পর ভাইয়ের সাইকেলে চেপে বাড়ি ফিরছিলেন রিঙ্কু দাস। মদ্যপ দুষ্কৃতীরা সাইকেল থামিয়ে তাঁর শ্লীলতাহানি করে। বাধা দিতে গিয়ে ছুরির আঘাতে মৃত্যু হয় রিঙ্কুর ভাই রাজীবের। রিঙ্কু ছুটে গিয়ে সাহায্য চান জেলাশাসক ও অতিরিক্ত এসপি-র বাংলোর নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেননি।
এই ঘটনা নিয়ে তৈরি সিনেমা যে দিন মুক্তি পেল, ঘটনাচক্রে সে দিনই মুক্তিপণ দিয়ে তবে মেয়েকে ফিরে পেলেন ব্যবসায়ী নিতাই দাস। পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেড় লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে শিশুটিকে ফিরিয়ে আনতে হয়েছে। টাকা পাওয়ার পর এ দিন ভোরে ফোনে তাঁদের জানানো হয়, অনুষ্কা পড়ে রয়েছে বারাসত হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে।
এক বছরের ব্যবধানে এই ঘটনা প্রমাণ করে দিল, বারাসতের নিরাপত্তার ছবিটা সত্যিই বদলায়নি। বাসিন্দাদের অভিযোগ, ‘‘বারাসত যেন কয়েক বছর আগের বিহারকে মনে করিয়ে দিচ্ছে।” ভাইকে চোখের সামনে আক্রান্ত হতে দেখে রিঙ্কু ছুটে গিয়েছিলেন সরকারি কর্তাদের বাংলোর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশকর্মীদের কাছে। কিন্তু সাহায্য মেলেনি। দশ বছরের বোনকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলেও সাহায্য পায়নি দাদা রনি। মেয়ের অপহরণের ঘটনা জানিয়ে পুলিশের উপরে ভরসা রাখতে পারেননি নিতাইবাবু। অপহরণকারীদের টাকা দিয়েই ফিরিয়ে এনেছেন অনুষ্কাকে।
নিতাইবাবুর কাছে অনুষ্কা বলেছে, গাড়িতে তোলার পরেই তার হাত বেঁধে দেয় অপহরণকারীরা। মুখে লিউকোপ্লাস্ট আটকে দেওয়া হয়। এর পরে দুষ্কৃতীরা একটি ইঞ্জেকশন দেয় তাকে। এর পরে আর কিছু মনে নেই বলে অনুষ্কা জানিয়েছে। এ দিন জ্ঞান ফেরার পরে সে দেখে, হাসপাতালের সামনে পড়ে রয়েছে। নিতাইবাবু আরও বলেন, “মেয়েকে অক্ষত অবস্থায় ফেরত পাওয়ার জন্যই মুক্তিপণ দিয়েছি। এ ছাড়া কী-ই বা করার ছিল!”
পুলিশের উপরে আস্থার হারানোর এই চিত্র এখন বারাসতের সর্বত্রই। এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, “রাজীব হত্যার পর নিরাপত্তা বাড়ানোর কথা বলেছিল প্রশাসন। আলো লেগেছিল, টহল বেড়েছিল। কিন্তু সবই যে সাময়িক, তা প্রমাণ হয়ে যায় মাস কয়েকের মধ্যেই।” যেমন, মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন এক পুলিশকর্মীর স্ত্রী। রাজীব-হত্যার ঘটনাস্থলের কাছেই তাঁর সোনার হার ছিনতাই করে দুষ্কৃতীরা। ওই ঘটনার কয়েক দিন পরে ওই জায়গাতেই পুলিশকে তাক করে গুলি ছুড়ে পালায় ছিনতাইবাজরা। মাসখানেক আগে বিয়ে করে ফিরছিলেন এক নবদম্পতি। বারাসত কাজিপাড়ার কাছে গাড়ি থামিয়ে লুঠপাট, মারধর চালায় ছিনতাইবাজেরা। ওই ঘটনার পর দিনই দত্তপুকুরে ডাকাতদের হাতে জখম হন এক বৃদ্ধা। দিন ১৫ আগে, বারাসতের কেমিয়া খামারপাড়ায় এক ব্যবসায়ী-সহ তিন জনকে খুন করা হয়। ওই ঘটনায় জড়িত হিসেবে প্রভাস ঢালী নামে এক কুখ্যাত দুষ্কৃতীর নাম উঠে এসেছিল। কিন্তু তাকে এখনও ধরতে পারেনি পুলিশ।
এর মধ্যেই আবার এসে পড়ল শিশু অপহরণের ঘটনা। ‘আটটা আট-এর বনগাঁ লোকাল’-এর পরিচালক দেবাদিত্যর বাড়িও বারাসতে। তিনি বলেন, “ছবির মুক্তির আগেই এমন একটা ঘটনা ঘটা খুবই উদ্বেগের।” |