অনিল বিশ্বাস-জমানার শিক্ষায় ‘রাজনীতিকরণে’র ভূত যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ঘাড় থেকে নামাতে চাইছে, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিলেন রাজ্য মন্ত্রিসভার বর্ষীয়ান সদস্য সুব্রত মুখোপাধ্যায়।
শুক্রবার মহাকরণে সুব্রতবাবু যা বলেছেন, তার মোদ্দা কথা শিক্ষকদের রাজনৈতিক মতাদর্শ, চেতনা বা পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে। সেটা সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্দরে কোনও শিক্ষকেরই ‘রাজনীতিক’ পরিচয় হওয়াটা অনভিপ্রেত। সে তিনি সিপিএম-ই হোন বা তৃণমূল!
রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থায় ‘অনিলায়ন’ সম্পর্কে অবহিত থাকার ফলেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হয়ে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেন্টর গ্রুপ গঠনের মতো পদক্ষেপ করেছিলেন। যেখানে ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ-সহ পঠনপাঠন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন ‘যোগ্য’ শিক্ষাব্রতীরা। সেখানে কোনও রাজনীতিক জড়িত থাকবেন না। ‘নীতিগত’ ভাবে নতুন সরকার সেই রাস্তাতেই হাঁটতে চাইছে। সেই কারণেই বিধানসভায় বিশ্ববিদ্যালয় বিলও আনা হয়েছে। এ দিন সুব্রতবাবুও বলেছেন, “শিক্ষার রাজনীতিকরণ বন্ধ করতে হবে।”
দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড় কলেজের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়েই সুব্রতবাবুর ওই মন্তব্য। ওই কলেজের এক শিক্ষিকাকে ‘নিগ্রহ’ করায় ‘অভিযুক্ত’ তৃণমূলের প্রাক্তন বিধায়ক আরাবুল ইসলাম। যা নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে বিতর্ক চলছে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষিকা ‘সিপিএমের লোক’ বলে অভিযোগ করেছে শাসক দল। ‘নিগৃহীত’ হওয়ার পর তিনি কেন পুলিশের কাছে গেলেন না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। |
ঘটনাচক্রে, এ দিনই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির (ওয়েবকুটা) নেতৃত্বে ওই কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশ রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের সঙ্গে দেখা করতে যান। রাজভবন থেকে বেরিয়ে ওয়েবকুটার সাধারণ সম্পাদক তরুণ পাত্র বলেন, “রাজ্যপালকে সব জানানো হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষিকারা কতটা ভীত হয়ে আছেন, এমনকী, তাঁরা যে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতেও ভয় পাচ্ছেন, তা-ও জানানো হয়েছে। উনি পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছেন। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন।”
ওই কলেজের শিক্ষক তথা কলেজের পরিচালন সমিতির সদস্য সুব্রত গোস্বামী পরে বলেন, “সব শুনে রাজ্যপাল বলেছেন, তিনি আহত। তাঁর পক্ষে যা করার তিনি তা করবেন বলে জানিয়েছেন।” পাশাপাশিই ওই প্রতিনিধিদের দাবি, রাজ্যপাল তাঁদের জানিয়েছেন, ঘটনা ঘটার পরেই তা সরকারি স্তরে ‘নথিভুক্ত’ করানো উচিত ছিল। তার পরেই এ দিন রাতে দেবযানী দে-সহ ৯ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা দক্ষিণ ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গ্রামীণ) কঙ্করপ্রসাদ বারুইয়ের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশ সূত্রের খবর আরাবুল ইসলাম এবং তাঁর ছেলে হাকিবুল ইসলামের (ভাঙড় কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক) বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে।
কিন্তু ভাঙড়ের ঘটনা আবার শিক্ষার রাজনীতিকরণকে সামনে এনে ফেলেছে। বস্তুত, তৃণমূলের একাংশের অভিমত, এ দিন দলের প্রবীণ নেতা সুব্রতবাবু যা বলেছেন, ছাত্র সংগঠনের
নেতা শঙ্কু পান্ডা বৃহস্পতিবার ভাঙড়ের পথসভায় প্রকারান্তরে সেটাই বলতে চেয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য প্রকাশের ‘ভঙ্গি’ নিয়ে অবশ্য দলের বড় অংশের আপত্তি রয়েছে। আপত্তি রয়েছে, যে ভাবে নিজের দলের মারফৎ শিক্ষায় রাজনীতিকরণের প্রসঙ্গ এড়িয়ে তিনি একমাত্র সিপিএম-কেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন, তা নিয়েও। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে দল এবং সরকার যে শিক্ষাকে ‘রাজনীতি মুক্ত’ করতে চায়, তা নিয়ে দলের কোনও পর্যায়েই দ্বিমত নেই।
তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “আমাদের সরকার এক রাস্তা বার করার চেষ্টা করছে। বাম-জমানার ভূত কী ভাবে ঘাড় থেকে নামানো যায়, সে পথ আমরা খুঁজছি। প্রাথমিক ভাবে সেই চেষ্টাও শুরু হয়েছে। তা সফল হবে না ব্যর্থ, তা ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু সমস্যাটা সম্পর্কে আমরা সচেতন।”
এ দিন মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী ভাঙড় কলেজের ঘটনা নিয়ে বলার দায়িত্ব দিয়েছিলেন সুব্রতবাবুকে। রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী যা বলেছেন, তাতে এটা স্পষ্ট যে, দল এখনও আরাবুলের ‘পাশে’ই রয়েছে। তবে সুব্রতবাবু জানিয়েছেন, আরাবুল কলেজের শিক্ষিকাকে ‘নিগ্রহ’ করে থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে সরকার। কিন্তু সেই মর্মে কোনও রিপোর্ট এখনও সরকারের কাছে আসেনি। এখনও পর্যন্ত যা রিপোর্ট এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, আরাবুল এবং দেবযানী দে নামে ওই শিক্ষিকার মধ্যে উত্তপ্ত বাদানুবাদ হয়েছিল। কিন্তু জলের জগ ছুড়ে মারার ঘটনা ঘটেনি। মন্ত্রীর কথায়, “সে দিন অধ্যাপিকার সঙ্গে আরাবুলের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের চেয়ে বেশি কিছু ঘটেনি। যা বলা হচ্ছে কিংবা দেখানো হচ্ছে, তা সরকারি ভাবে সত্য নয়। কোনও এফআইআর-ও দায়ের হয়নি। জগ ছুড়ে মারলে মাথায় লাগুক বা থুতনিতে, তার মেডিক্যাল পরীক্ষা হবে এবং এফআইআর দায়ের করা হবে। সে সব কিছু হয়নি। সে সব না-করে জগ দিয়ে মেরেছে বা লাঠি দিয়ে মেরেছে এ সব তথ্য পরিবেশন করে লাভ কী!” সুব্রতবাবুর আরও বক্তব্য, “আরাবুল ওই কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি। ওখানে ও যাবে না তো কি আমি যাব!”
এর পরেই সুব্রতবাবু বলেন, “ছাত্র পড়াশোনা না-করে রাজনীতি করলে বা অধ্যাপক বই না-নিয়ে ব্যাগে পোস্টার নিয়ে কলেজে ঢুকলে তার তো প্রতিবাদ হওয়াই উচিত! বলছি না যে, রাজনীতি করা ছেড়ে দিতে হবে। যার যা রাজনীতি, তা তিনি করবেন। কিন্তু শিক্ষকরা শিক্ষা ক্ষেত্রে, ডাক্তাররা রোগী দেখতে দেখতে, দমকল আগুন নেভাতে গিয়ে রাজনীতি করলে অবশ্যই তার প্রতিবাদ করা উচিত। মানুষের রাজনৈতিক চেতনা থাকতে পারে। কিন্তু ডাক্তার বা শিক্ষকরা তাঁদের পদ ব্যবহার করে রাজনীতি করবেন, এটা ঠিক নয়। পেশাকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করে তা কলুষিত করলে তা সহ্য করা হবে না।”
তৃণমূলের প্রথম সারির নেতৃত্বের অভিমত, সুব্রতবাবুর ওই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট যে, সরকার সামগ্রিক ভাবেই শিক্ষাকে রাজনীতি মুক্ত করতে চাইছে। সেই জন্যই ‘প্রতিবাদ’ করেছিলেন আরাবুলও। শিক্ষিকার সঙ্গে আঙুল উঁচিয়ে কথা বলা তাঁর অনুচিত হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু যে বিষয়ে তাঁর ‘আপত্তি’, তাতে দল ও প্রশাসনের ‘সমর্থন’ রয়েছে। যদিও দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “আরাবুল যে শিক্ষাকে রাজনীতি মুক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে ওই কলেজে গিয়েছিল, তা বলা যাচ্ছে না। ওর আপত্তি নির্দিষ্ট করে সিপিএম নিয়েই। কিন্তু নীতিগত ভাবে প্রশাসন মনে করে, এ ক্ষেত্রে রং দেখা অনুচিত।”
ওই ঘটনার প্রতিবাদে সরব এসএফআই-ও। সংগঠনের রাজ্য সভাপতি সায়নদীপ মিত্রের কথায়, “এই সব ঘটনায় আরাবুলের মতো সমাজবিরোধীরা প্রশ্রয় পাচ্ছে। সরকারের উচিত এই সমাজ বিরোধীদের গ্রেফতার করা। কিন্তু তা হচ্ছে না। বোঝাই যাচ্ছে, এতে সরকারের সায় আছে।”
ছাত্রনেতা শঙ্কুর বক্তব্য নিয়ে সরব হয়েছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও। এদিন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, “গ্রামে একটা কথা আছে। পচা (পুরনো অর্থে) পুকুরের ঘাটে বসলে যদি শোলপোনা চিকচিক করতে দেখা যায়, তা হলে বুঝতে হবে গভীর জলে ভারী শোল আছে। শোলপোনার পিছনে ছুটে কোনও লাভ নেই! ভারী শোল দেখতে হবে!” ভাঙড়-কাণ্ড নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার সতীর্থ সুব্রতবাবুর দিকে ইঙ্গিত করে সূর্যবাবু বোঝাতে চেয়েছেন নিচু তলায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা যা করছেন, সে সবে উচ্চ নেতৃত্বের ‘প্রশ্রয়’ আছে। |