আসছে পুরভোট। ফিরছে রাজনীতির লড়াই। কিন্তু কেমন আছে দুর্গাপুর?
ওয়ার্ডে ঘুরে-ঘুরে খোঁজ নিচ্ছে আনন্দবাজার। আজ ওয়ার্ড ২১ ও ২২। |
বাসিন্দাদের দাবি অনুযায়ী উন্নয়নের কাজ হয়েছে দাবি করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন এক জন। অনেক কাজ হয়ে গিয়েছে, সামান্য কিছু বাকি। দাবি আর এক জনের। দুর্গাপুর পুরসভার ২১ ও ২২ নম্বর ওয়ার্ডের এই দুই কাউন্সিলর নিজেদের কাজে ‘তৃপ্ত’ হলেও এলাকাবাসীর গলায় অবশ্য অন্য সুর।
পুরসভায় শুধুমাত্র তাঁর ওয়ার্ডের সব স্কুলেই মিড-ডে মিল চালু হয়েছে, এমন তথ্য জানানোর সময়ে রীতিমতো শ্লাঘা ঝরে পড়ল ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অধীর ঘোষের গলায়। পুর এলাকায় স্কুলগুলিতে মিড-ডে মিল চালু করতে রীতিমতো কালঘাম ছুটে যাচ্ছে প্রশাসনের। সেই পরিস্থিতিতে এমন ‘সাফল্য’র নিয়ে তৃপ্ত ডিএসপি-র এই কর্মী।
নেতাজি কলোনি, সারদা পল্লি, তপোবন, আনন্দপুরি, রাঁচি কলোনি, চাষি পাড়া, এনআইটি সংলগ্ন বস্তি নিয়ে এই ২১ নম্বর ওয়ার্ড। সিটি সেন্টার থেকে দূরত্ব সামান্যই। কিন্তু সমস্যার অন্ত নেই। অধীরবাবু জানান, কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েই তিনি এলাকার উন্নয়নে একটি বিশেষ পদ্ধতির সাহায্য নিয়েছিলেন। বাসিন্দারা তাঁদের না পাওয়ার একটি তালিকা তুলে দিয়েছিলেন তাঁর হাতে। সেই তালিকা ধরে একের পর এক কাজ করা হয়ে গিয়েছে দাবি অধীরবাবুর।
তাঁর দাবি, ওয়ার্ডের সর্বত্র পাকা রাস্তা হয়ে গিয়েছে। সারদাপল্লি আনন্দপুরি বস্তিতে বৃষ্টি হলেই অন্তত দেড়শো ঘরে জল ঢুকে যেত। এখন বর্ষায় সেখানে জলই জমে না। রাস্তা মেরামত হয়েছে। বাস চালু হয়েছে। বিপিএল তালিকাভুক্তদের জন্য প্রায় দেড়শো বাড়ি তৈরি হয়েছে। তা হলে কি ওয়ার্ডে কোনও সমস্যাই নেই? কাউন্সিলর বলেন, “পানীয় জলের কিছু সমস্যা এখনও আছে। তবে জলাধার নির্মাণের কাজ চলছে। তা হয়ে গেলে এই সমস্যাও মিটে যাবে।” |
ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের গলায় অবশ্য ভিন্ন সুর শোনা গেল। আনন্দপুরির বাসিন্দা প্রতীক ঘোষ মল্লিক বলেন, “নর্দমায় পাঁক ও আগাছা থাকায় জল নিকাশি ঠিকমতো হয় না।” রাঁচি কলোনির বাসিন্দা আরতি হালদার বলেন, “সব রাস্তায় আলো নেই। রাতে যাতায়াতে অসুবিধা হয়।” দাসপাড়ায় ঢোকার মুখেই একটি মজা কুয়ো। বাসিন্দারা সেখানে জঞ্জাল ফেলছেন। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, ওই কুয়ো ধসে গিয়েছে বহুদিন আগেই। কিন্তু সারানোর কোনও উদ্যোগ নেয়নি পুরসভা। জীব জন্তু কুয়োয় পড়ে গিয়েছে বেশ কয়েকবার। তারপর থেকে বাসিন্দারা সেখানে জঞ্জাল ফেলেন। চাষিপাড়ার রেনুবালা হালদারের অভিযোগ, বিপিএল তালিকায় নাম আছে। কিন্তু প্রাপ্য ভাতা মেলে না।
স্থানীয় তৃণমূল নেতা চন্দন সাহা আবার বলছেন, “চাষিপাড়ায় কমিউনিটি শৌচাগার নেই। রাস্তা হয়নি। আলোর কোনও ব্যবস্থা না থাকায় রাতে চলাচল করা দায়।” এ সব শুনে কাউন্সিলর অধীরবাবুর মন্তব্য, “স্মৃতি বড়ই ক্ষণস্থায়ী! পাঁচ বছর আগে এই ওয়ার্ডের কী পরিস্থিতি ছিল, তা আজ আর কেউ ভাবছেন না।”
পুরসভার ২২ নম্বর ওয়ার্ডকে অবশ্য ‘প্রদীপের তলায় অন্ধকার’ আখ্যা দেওয়াই যায়। এই ওয়ার্ডে রয়েছে শহরের সবচেয়ে অভিজাত এলাকা সিটি সেন্টার, সেল-কো-অপারেটিভ, নন-কোম্পানি, রিকল পার্ক, সিমেন্ট পার্ক, গ্রিন পার্ক, বেঙ্গল অম্বুজা হাউসিং। সুদৃশ্য বাড়ি, একাধিক বহুতল, তিনটি শপিং মল, হোটেল, দেশ-বিদেশের নানা সংস্থার শো-রুম। কিন্তু এ সবের পাশাপাশিই রয়েছে বরফকল বস্তি, সি-জোন বস্তি, সিএমইআরআই বস্তি, ৬ নম্বর জলট্যাঙ্কি বস্তি এলাকাও।
এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রাক্তন ডিএসপি কর্মী প্রভাত চট্টোপাধ্যায় আবার মেয়র পারিষদ (পূর্ত ও বিবিধ)। বিরোধীদের অভিযোগ, মেয়র পারিষদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজের ওয়ার্ডের প্রতি তেমন নজর দেননি কাউন্সিলর। প্রভাতবাবু অবশ্য এই অভিযোগ মানতে নারাজ।
কাজ হয়েছে কেমন? পাওয়া গেল নানা বক্তব্য। সিটি সেন্টারের নন-কোম্পানি এলাকার বাসিন্দা দেবাশিস বসু বলেন, “গত কয়েক বছরে সিটি সেন্টার আমূল বদলে গিয়েছে।” আর এক বাসিন্দা শ্যামল সাধু বলেন, “বিএসইউপি প্রকল্পে ‘সোনার তরী’ আবাসন গড়ে দেওয়ায় বহু বস্তিবাসী উপকৃত হয়েছেন।” সোনার তরী নিয়ে আবার ক্ষুব্ধ সিএমইআরআই বস্তির বাসিন্দা জয়শঙ্কর সাউ। তিনি বলেন, “মূলত বস্তির বাসিন্দাদের জন্য সোনার তরী গড়া হল। কিন্তু বাইরে থেকে আসা লোকজন বাড়ি পেল, আমরা পেলাম না।” বরফকল বস্তির বাসিন্দা জগন্নাথ শর্মার অভিযোগ, “জলের সমস্যা মেটাতে পুরসভা কিছুই করেনি” সি-জোন বস্তির বাসিন্দা রাজা দাস আবার বলেন, “বহু আবেদন করেও বস্তিতে বিদ্যুৎ এল না।”
এলাকার তৃণমূল নেতা পরিমল অগস্তির অভিযোগ, “কাউন্সিলরের উদ্যোগে ‘হেরিটেজ’ পুকুর ঘিরে আবাসন গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল আগের এডিডিএ বোর্ড। আমরা আন্দোলন করে আপাতত স্থগিত রেখেছি।” তাঁর আরও দাবি, সেল-কো-অপারেটিভ মাঠেও একটি নির্মাণ সংস্থাকে বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স গড়ার জন্য দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা সেটিরও কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন বলে জানান পরিমলবাবু। স্থানীয় বাসিন্দা উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় জানান, পুরসভাকে উঁচু হারে কর দিয়েও কোনও পরিষেবা মেলে না। ১৮ ও ২৮ নম্বর স্ট্রিটে পানীয় জলের আকাল রয়েছে। মৌলানা আজাদ রোডের বাসিন্দা বিনায়ক রায় বলেন, “সিটি সেন্টারে শপিং মল গড়া হয়েছে। অথচ পার্কিংয়ের কোনও ব্যবস্থা নেই।”
কিছু সমস্যা যে আছে তা স্বীকার করেছেন কাউন্সিলর প্রভাতবাবুও। তবে তিনি জানান, ডিরোজিও পথ ছাড়া ওয়ার্ডের সব রাস্তার সংস্কার হয়ে গিয়েছে।
|
নজরে নগর |
ওয়ার্ড ২১ |
ওয়ার্ড ২২ |
• রাস্তায় আলোর বড়ই অভাব
• নিয়মিত জঞ্জাল সাফাই হয় না
• মজা নর্দমা, পাঁক আর আগাছায় ভরা |
• বস্তির সব বাড়িতে বিদ্যুৎ যায়নি
• বিএসইউপি-র সুফল পৌঁছয়নি সর্বত্র
• পানীয় জলের সমস্যা |
সব স্কুলে মিড ডে মিল, এলাকার
উন্নয়ন নিয়ে আমি তৃপ্ত।
অধীর ঘোষ, সিপিএম কাউন্সিলর |
ধারাবাহিক ভাবে উন্নয়নের
কাজ হয়েছে ওয়ার্ড জুড়েই।
প্রভাত চট্টোপাধ্যায়, সিপিএম কাউন্সিলর |
রাস্তা, আলো, শৌচাগার নেই। এলাকায়
উন্নয়নের কোনও কাজই হয়নি।
চন্দন সাহা, তৃণমূল নেতা |
অভাব অভিযোগ কাউন্সিলরকে
জানাতেই পারেননি বাসিন্দারা।
শান্তনু সোম, তৃণমূল যুব নেতা |
|