চিকিৎসকদের নানা রকম উপঢৌকন বা সুবিধা দিয়ে বিশেষ কোনও ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখতে বিভিন্ন ওষুধ সংস্থা প্রভাবিত করছে বলে অভিযোগ বহুদিনের। এমনকী, হাসপাতালে সরকারি ওষুধ অধিকাংশ সময়ে অমিল থাকার পিছনেও এই সব সংস্থার হাত রয়েছে বলেও বারবার অভিযোগ উঠেছে। তার পরেও যে ওষুধ সংস্থার রাজত্ব সরকারি হাসপাতালের শিকড়ে প্রবেশ করেছে, তার প্রমাণ আরও এক বার পাওয়া গেল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
সেখানে আউটডোর ভবনে সর্বসমক্ষে টেবিল-চেয়ার নিয়ে মৌরসিপাট্টা গেড়ে বসেছেন একাধিক ওষুধ ও ইঞ্জেকশন প্রস্তুতকারী সংস্থার কর্মী। তাঁরাই রোগীদের সুগার পরীক্ষা করছেন। ডায়েট চার্ট বানিয়ে দিচ্ছেন। পাশাপাশি রোগীদের মধ্যে নিজেদের সংস্থার ওষুধ ও ইঞ্জেকশনের প্রচারের কাজটাও সেরে ফেলছেন। ওই ওষুধ ও ইঞ্জেকশন কেনানোর ব্যবস্থাও করে দিচ্ছেন। চিকিৎসকেরাও হাসপাতালের স্বীকৃত ডায়েটিশিয়ানদের কাছে রোগীকে না-পাঠিয়ে সরাসরি ওই ওষুধ সংস্থার প্রতিনিধিদের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
ঘটনা শুনে স্তম্ভিত রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “যাতে ওষুধ নিয়ে দুর্নীতি না-হয়, সে জন্য কাজের সময়ে সরকারি হাসপাতালে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ ঢোকাও নিষিদ্ধ। চিকিৎসকেরা কাজের শেষে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। কিন্তু আউটডোরে টেবিল পেতে রোগী দেখা দূর অস্ৎ, সেখানকার ত্রিসীমানায় ওষুধ সংস্থার কারও আসার কথা নয়। অবিলম্বে খোঁজ নিচ্ছি। তেমন হলে এফআইআর-ও করতে হবে।” |
স্বাস্থ্য দফতর প্রমাণ পাক বা না-পাক, গত ২০ এপ্রিল, শুক্রবার সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ মেডিক্যালের আউটডোরের তিনতলায় গিয়েই দেখা পাওয়া গেল বিভিন্ন বেসরকারি ওষুধ সংস্থার সেই প্রতিনিধিদের। প্রত্যেক বিভাগের আউটডোরেই তাঁরা রোগীর ভিড় সামলাচ্ছেন, লাইন ঠিক করে দিচ্ছেন, চিকিৎসকদের জন্য ঠান্ডা জলের বোতল ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন, রোগীদের ওজন মাপছেন। বিশেষত এন্ডোক্রিনোলজি বিভাগের হয়ে আউটডোরের মধ্যেই চওড়া করিডরের এক প্রান্তে তাঁরা টেবিল পেতে বসে রোগী দেখছেন!
কী ভাবে এঁরা সরকারি মেডিক্যাল কলেজের আউটডোরে বসে রোগীদের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি পান? এন্ডোক্রিনোলজির এক প্রবীণ চিকিৎসক বললেন, “আমাদের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী নেই। অগত্যা এই ওষুধ সংস্থার লোকেরাই সাহায্য করে দেন। আউটডোর ভবনে পানীয় জলের লাইন নেই। ওঁরা জল আনেন। সরকার তো এই সব অসুবিধার দিকে নজর দেয় না। ওঁরা দেন। তার বদলে ওঁদের তো কিছু সুবিধা দিতে হবে।”
তা বলে আউটডোরের মধ্যে বসার জায়গা? চিকিৎসকদের জবাব, এন্ডোক্রিনোলজি বিভাগে বেশির ভাগ ডায়াবিটিসের রোগী, বেশি মোটা বা বেশি রোগা হয়ে যাওয়া রোগী বা থাইরয়েডের রোগী আসেন। এঁদের ডায়েট খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আউটডোর ভবনে ডায়েটিশিয়ানদের বসার ঘর নেই। তাঁদের বসতে হয় হাসপাতালের অন্য প্রান্তে, রান্নাঘরের পাশে স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার ঘরে। বেশির ভাগ রোগী সেখানে যেতে চান না, বা খুঁজে পান না। তাঁদের সুবিধার জন্য একটি ইনসুলিন প্রস্তুতকারী সংস্থা কিছু ডায়াবিটিস ইনস্ট্রাক্টরকে আউটডোর চত্বরে বসিয়েছে।
চিকিৎসকদের কথায়, “ওঁরা রোগীদের কাউন্সেলিং করেন, ডায়েট চার্ট করে দেন। নিখরচায় এই পরিষেবার প্রতিদানে যদি ওঁদের কিছু ওষুধ বা ইনসুলিন বিক্রি হয়, ক্ষতি কী?” কিন্তু প্রশ্ন হল, আউটডোরের যেখানে ওষুধ সংস্থার লোক টেবিল পেতে বসছেন, সেখানে সরকারি ডায়েটিশিয়ানেরা বসতে পারেন না? তা হলে রোগীদের অন্যত্র গিয়ে তাঁদের খুঁজতে হয় না। এখানে আবার ডায়েটিশিয়ানেরা বেঁকে বসে বলছেন, “আলাদা ঘর না পাওয়া পর্যন্ত আমরা যাব না।” ফলে দেদার রোগী পাচ্ছেন বেসরকারি ওষুধ সংস্থার ডায়াবিটিক ইনস্ট্রাক্টর। সরকারি হাসপাতালের রোগীদের কাছেই রমরমিয়ে বিক্রি হচ্ছে তাদের ওষুধ আর ইনসুলিন। |