তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন, ভাঙড়ের প্রাক্তন বিধায়ক আরাবুল ইসলাম কলেজের শিক্ষিকাকে ‘হুমকি’ দিয়ে থাকলে দল তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। প্রকারান্তরে কিন্তু দলীয় নেতার ‘পাশে’ই আছেন মহাসচিব।
এ দিনও ভাঙড় কলেজ ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন আরাবুল। টিভি ক্যামেরার সামনে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে তর্জনী উঁচিয়ে বলেছেন, “আমি ওই শিক্ষিকাকে বলি, আপনি কে? গলা নামিয়ে কথা বলুন! কে আপনাকে আঙুল উঁচিয়ে কথা বলার অধিকার দিয়েছে?” ওই শিক্ষিকা ‘কাঠ সিপিএমের মতো’ কথা বলছিলেন জানিয়ে আরাবুলের আরও বক্তব্য, “লিউকোপ্লাস্ট খুলে দেখা হোক, শিক্ষিকার আদৌ আঘাত লেগেছে কি না।”
মঙ্গলবার শিক্ষিকাকে কটূক্তি এবং জগ ছুড়ে মারার অভিযোগ উঠেছিল আরাবুলের বিরুদ্ধে। মঙ্গলবারই পার্থবাবু জানিয়েছিলেন, ‘বিশৃঙ্খলা বরদাস্ত করা হবে না’। তার পরেও এ দিন আরাবুলের ভাবভঙ্গিতে কোনও বদল চোখে না-পড়ায় প্রশ্ন উঠছে, দলের তরফে আরাবুলকে আদৌ ‘সংযত’ হতে বলা হয়েছে কি? |
উপরন্তু বুধবার পার্থবাবু ভাঙড়ের ঘটনা সম্পর্কে যে সব প্রশ্ন তুলেছেন, তাতেও ইঙ্গিত স্পষ্ট তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব আরাবুলের ‘পাশে’ই রয়েছে। রাজ্য মন্ত্রিসভার দু’নম্বর সদস্য পার্থবাবু এ দিন বলেন, আরাবুল যদি হুমকি দিয়ে থাকেন, তার নেপথ্যে কী আছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার। দ্বিতীয়ত, ঠিক কোন প্রেক্ষিতে ঘটনার সূত্রপাত হয়, দেখা দরকার তা-ও। তৃতীয়ত, ওই শিক্ষিকা হাসপাতাল, পুলিশ বা কোনও সরকারি দফতরে না-গিয়ে ওয়েবকুটায় অভিযোগ জানাতে গেলেন কেন? পার্থবাবুর কথায়, “ওই সংগঠন (ওয়েবকুটা) তো তাঁদের কলেজে নিয়োগ করেনি!” শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অবশ্য বক্তব্য, কলেজের অধ্যক্ষ তাঁদের সঙ্গে ‘সহযোগিতা’ না-করাতেই তাঁরা ওয়েবকুটার কাছে গিয়েছিলেন।
শিক্ষিকা নিগ্রহের অভিযোগের পিছনে ‘রাজনৈতিক’ উদ্দেশ্য রয়েছে বলে জানিয়ে পার্থবাবু এ দিন এ কথাও বলেন যে, হাসপাতালে না-যাওয়ায় শিক্ষিকার আঘাত নিয়েই সংশয়ের অবকাশ রয়েছে! রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও এ দিন মহাকরণে জানিয়েছেন, আরাবুল আদৌ শিক্ষিকাকে লক্ষ্য করে জলের জগ ছুড়ে মারেননি। ভাঙড় কলেজের এই ঘটনা নিয়ে একটি রিপোর্ট এ দিন সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জমা পড়েছে। দলীয় সূত্রের খবর, রিপোর্টে দু’পক্ষের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদের কথা বলা আছে। কিন্তু জগ ছুড়ে মারার প্রসঙ্গটা সেখানে শুধুমাত্র একটি ‘অভিযোগ’ বলেই উল্লিখিত হয়েছে।
|
জখম শিক্ষিকা
দেবযানী দে। |
ওই দিনের ঘটনার ‘সূত্রপাত’ কী করে হল, সে প্রসঙ্গ তুলে পার্থবাবু এ দিন বলেছেন, “পাঁচ জনের শিক্ষক কমিটিতে দুই সিপিএম সমর্থক এবং দুই তৃণমূল সমর্থক থাকবেন, তা আগেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। পঞ্চম জনের নাম ঠিক করতেই আরাবুল কলেজে যান। উনি স্টাফরুমে যাওয়ায় ওই শিক্ষিকা তাঁকে বেরিয়ে যেতে বলেন।” কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশের বক্তব্য, শিক্ষক কমিটির নির্বাচনে প্রার্থী ঠিক করায় পরিচালন সমিতির নাক গলানোর কথা নয়! ক্ষমতায় এসে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব নিজেরাই জানিয়েছিলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রাখা হবে। তা হলে কলেজে কলেজে মন্ত্রী-বিধায়ক-দলীয় নেতাদের পরিচালন সমিতির সভাপতি করা হচ্ছে কেন? সরাসরি জবাব এড়িয়ে পার্থবাবু বলেন, “নিরপেক্ষতা মানে কি এই যে, আমরাই নিরপেক্ষ হব? আর কলেজের ভিতরে পক্ষপাত থাকবে?” অনেকটা একই ভাবে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও প্রশ্ন তুলেছেন, “ওয়েবকুটা-র নির্বাচনে কারা কাকে ভোট দেবেন, সব ওই পরিচালন সমিতির সভাপতি বলে দেবেন?” আরাবুলের ‘কাঠ সিপিএম’ মন্তব্য নিয়ে সূর্যবাবুর বক্তব্য, “ওই শিক্ষিকার রাজনৈতিক পরিচয় জানি না। কিন্তু পরিচালন সমিতির সভাপতির শুধু রাজনীতি করার অধিকার থাকবে, আর কারও নয়, এ তো স্বৈরতন্ত্র!” |
সিপিএম এ দিন আরাবুলের গ্রেফতার ছাড়াও তাঁকে অবিলম্বে পরিচালন সমিতির সাধারণ সদস্যের পদ থেকে সরানোর দাবি তুলেছে। ‘আহত’ শিক্ষিকার পাশে দাঁড়িয়ে বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী আমাদের মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগাতে বলেছিলেন। আর ইনি (আরাবুল) লিউকোপ্লাস্ট সরিয়ে দেখতে বলছেন আঘাত লেগেছে কি না!” আরাবুল এবং তাঁর সঙ্গীদের (যাঁরা ওঁর সঙ্গে কলেজে গিয়েছিলেন) গ্রেফতারের দাবি জানান সূর্যবাবু। তিনি বলেন, “এফআইআর হয়েছে কি না, জানি না। তবে বোঝা যাচ্ছে, এফআইআর করার মতো অবস্থা ওখানে নেই। আমি আইনজ্ঞ নই। তবে সংবাদমাধ্যমের খবরের ভিত্তিতে পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত ভাবেই এফআইআর করতে পারে।”
রায়গঞ্জ, মাজদিয়ার পর ভাঙড় কলেজের এই ঘটনায় শিক্ষা ক্ষেত্রে ‘অরাজকতা’র অশনি সঙ্কেত দেখতে শুরু করেছেন রাজনীতি এবং শিক্ষা জগতের মানুষজন। তৃণমূলের জোট শরিক কংগ্রেসের শিক্ষা সেল ঘটনার নিন্দা করে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছে। অন্য দিকে বিরোধী দলনেতার অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রীর ‘সমর্থন’ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে-কলেজে এই জাতীয় ঘটনার ধারাবাহিক পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে না।
|