রাজধানীর রাজনৈতিক অলিন্দে সহসা জল্পনা: ইউ পি এ সরকারের চার জন মন্ত্রী ইস্তফা দিয়া দলীয় সংগঠনের কাজে মনোনিবেশ করিতে চাহেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা এবং কংগ্রেস দলের মুখপাত্র সকলেই জোরের সঙ্গে মাথা নাড়িয়া বিষয়টিকে গুজব বলিয়া উড়াইয়া দিয়াছেন। এই উপলক্ষে ষাটের দশকের ‘কামরাজ প্ল্যান’-এর দৃষ্টান্তও টানিয়া আনা হইয়াছে। তাহা অস্বাভাবিক নহে। তবে, লক্ষ করিবার বিষয়, সেই পরিকল্পনা অনুসারে যাঁহারা মন্ত্রিত্ব ও সাংগঠনিক পদ হইতে ইস্তফা দিয়া নেহরুর মন্ত্রিসভা পুনর্গঠনের পথ প্রশস্ত করিয়াছিলেন, তাঁহারা সকলেই ছিলেন ওজনদার জননেতা, যাঁহাদের নির্ভরযোগ্য গণভিত্তি ছিল। এখন যাঁহাদের নাম শুনা যাইতেছে, সেই জয়রাম রমেশ, ভায়লার রবি, সলমন খুরশিদ কিংবা গুলাম নবি আজাদ সকলেই প্রধানত মন্ত্রী হিসাবে পরিচিত, দলীয় জননেতা বা সংগঠনের আধিকারিক হিসাবে তাঁহাদের তত ওজন নাই। মন্ত্রী হিসাবেও সরকারের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্ব তাঁহাদের হাতে নাই। সেই সব মন্ত্রক যাঁহাদের হস্তগত, সেই প্রণব মুখোপাধ্যায়, পি চিদম্বরম, এ কে অ্যান্টনি কিংবা এস এম কৃষ্ণ প্রমুখের নাম এই জল্পনার অন্তর্গত নহে। লক্ষ করিবার বিষয়, অন্তত দুই জন মন্ত্রীর-- প্রতিরক্ষা ও বিদেশ দফতরের ভারপ্রাপ্ত রাজনীতিকদের স্থানান্তর লইয়া অনেক জল্পনা অতীতে শোনা গিয়াছে। হয়তো আবারও শোনা যাইবে।
আপাতত জল্পনার পশ্চাদ্ধাবনের প্রয়োজন নাই। তবে এই উপলক্ষে একটি বৃহত্তর প্রসঙ্গ ওঠে। গুরুতরও বটে। মন্ত্রিসভা গঠন, তাহাতে সময়ে-সময়ে প্রয়োজনীয় রদবদল ঘটানোর কাজটি একান্ত ভাবেই প্রধানমন্ত্রীর। সংসদীয় শাসনতন্ত্রে ইহাই স্বাভাবিক যে তিনি আপন মন্ত্রিসভা গঠন করিবেন, মন্ত্রক বণ্টন করিবেন, অকর্মণ্য কিংবা অনিয়মে লিপ্ত দলীয় রাজনীতিকদের মন্ত্রিত্ব হইতে বহিষ্কার করিবেন। স্বাধীনতার পরে প্রথম কিছু কাল এই সুরীতি অনুসৃত হইয়াছিল। দুর্ভাগ্যবশত, কংগ্রেসের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নেহরু জমানার প্রথম পর্বের কাল হইতে অনেক দূরে সরিয়া আসিয়াছে। এখানে নেহরু-গাঁধী পরিবারের সদস্য না হইলে দলীয় সংগঠনের উপর যেমন কর্তৃত্ব কায়েম করা সম্ভব হয় না, তেমনই প্রধানমন্ত্রী হইয়াও দলীয় সংগঠনের শ্বাসরোধকর নিয়ন্ত্রণ, পছন্দ ও অগ্রাধিকার হইতে মুক্ত থাকা যায় না। দলপতিকে ঘিরিয়া তাঁহার অনুগ্রহপ্রার্থীদের যে হাই কমান্ড, তাহাই দলীয় সরকারের শাসনপ্রণালীকেও নিয়ন্ত্রিত করে।
এই রীতি ইউ পি এ আমলে দুর্ভাগ্যজনক ধারাবাহিকতা অনুসরণ করিতেছে। মনমোহন সিংহ কোনও পর্যায়েই সরকারের উপর তাঁহার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করিতে পারেন নাই, বা তাঁহাকে সেটা করিতে দেওয়া হয় নাই। তাঁহার অনিচ্ছাতেও যে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত একাধিক শরিক রাজনীতিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিত্ব পাইয়াছেন, এমন অনুমানের বিলক্ষণ হেতু আছে। তাঁহার অভিপ্রায় কদাচিৎ সরকারের অগ্রাধিকার হইয়া উঠিয়াছে। তাঁহার উদারনৈতিক আর্থিক সংস্কারের ঘোষিত এজেন্ডা বারংবার মধ্যপথে কিংবা সূচনাতেই হোঁচট খাইয়াছে সম্ভবত দলীয় রাজনীতিকদেরই অন্তর্ঘাতে, যাঁহারা আবার হাই কমান্ড তথা দলনেত্রীর আস্থাভাজন বলিয়া গণ্য। এই অবস্থায় স্থবির, চলচ্ছক্তিহীন, কল্পনাশক্তিরহিত, ঝুঁকি-লইতে-ভীত একটি দ্বিধাগ্রস্ত সরকারের কাণ্ডারিকে ‘কামরাজ প্ল্যান’, অনুসৃত হইলেও, পুনর্গঠন ও নববিন্যাসে কতটা সাহায্য করিবে, বলা কঠিন। |