পলিটবুরোর সদস্য হতে উদগ্রীব ছিলেন কেরলের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভি এস অচ্যুতানন্দন। কিন্তু দল তাঁকে পলিটব্যুরোয় নিল না। আর স্বাস্থ্যের কারণে চিঠি দিয়ে পলিটব্যুরো থেকে অব্যহতি চাইলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কিন্তু দল তাঁকে ছাড়ল না। এমনকী পলিটব্যুরোর স্থায়ী আমন্ত্রিত সদস্য না করে, ঠিক যে ভাবে তিনি ছিলেন, ঠিক সে ভাবেই তাঁকে রাখার সিদ্ধান্ত নিল।
সিপিএম সূত্র বলছে, এই ঘটনা থেকে প্রমাণ হয়ে গেল রাজ্য দলে আজও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যই অবিসংবাদী নেতা। তিনিই পশ্চিমবঙ্গে দলের প্রধান মুখ।
বুদ্ধবাবুর চিঠি পেয়ে সিপিএম সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট নিজে কলকাতা গিয়ে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। শরীর-স্বাস্থ্যের খোঁজ নিয়েছিলেন এবং পার্টি কংগ্রেসে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। বুদ্ধবাবু সেই আর্জি রাখেননি।
বহু দিন ধরেই বুদ্ধবাবু দিল্লিতে পলিটব্যুরো বা কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে আসেন না। পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করতে গিয়ে মনমোহন সিংহের সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের সময় থেকেই তিনি ‘পার্টি কেন্দ্রের’ ভূমিকায় অসন্তুষ্ট। রাজ্যে নির্বাচনী বিপর্যয়ের পরে শুধু বুদ্ধবাবু যাতে উপস্থিত থাকেন সে জন্য কলকাতায় পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছিল। কিন্তু সেই বৈঠকেরও উদ্বোধনী পর্বে বুদ্ধবাবু হাজির হননি। সিপিএমের একটি সূত্রের মতে, বুদ্ধবাবুর এহেন আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে একটা সময়ে তাঁকে পলিটব্যুরো থেকে সরানোর কথা ভেবেছিলেন কারাট। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রকে বুদ্ধবাবুর বিকল্প হিসেবে তুলে ধরার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বুদ্ধবাবুর পাশে সক্রিয় ভাবে দাঁড়ান রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু এবং পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি। তাঁদের মত ছিল বুদ্ধবাবু যা-ই বলুন, তাঁকে পলিটব্যুরো থেকে সরালে শুধু রাজ্য দলে নয়, আমজনতার মধ্যেও বিরূপ প্রভাব পড়বে।
বুদ্ধবাবুর এই রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণ কী?
সিপিএম নেতারা মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গে বুদ্ধবাবুর নেতৃত্বে দল এক নতুন পথের সন্ধান শুরু করেছিল। সংস্কারের পথ। আর্থিক উদারিকরণের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় একটি রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা কমিউনিস্ট পার্টিকে কী ভাবে এগোতে হবে, তার দিক নির্দেশ দিচ্ছিলেন বুদ্ধবাবুরা। বলেছিলেন, সাবেক মার্ক্সবাদের নতুন মূল্যায়ন করতে হবে, শিল্পায়নের পথে যেতে হবে ও সর্বোপরি দলকে আরও অনেক বেশি ভারতীয় হয়ে উঠতে হবে।
এর পর পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের নির্বাচনী বিপর্যয় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দলের অনেকেই মনে করেন, বুদ্ধবাবুদের পথটা ভুল ছিল না। নিরুপম সেনের মতো পলিটব্যুরোর সদস্য, যিনি এই নয়া পথে বুদ্ধবাবুর ‘সহযাত্রী’, তিনিও মনে করেন সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামে প্রশাসনিক ব্যর্থতা ঘটে থাকতে পারে; মানুষকে বোঝানোর অপারগতা থাকতে পারে; দীর্ঘ ৩৪ বছরের শাসনের ফলে দলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে থাকতে পারে; কিন্তু উন্নয়ন এবং শিল্পায়নের পথটা ভুল ছিল না। আর সেই কারণে কোঝিকোড়ের পার্টি কংগ্রেসে দল নতুন করে যে দলিল তৈরি করেছে তাতেও এটা স্পষ্ট, বিরোধী দল হলেও সিপিএমের পক্ষে আজ আর ষাট বা সত্তরের দশকের সিপিএম হওয়া সম্ভব নয়। নেতিবাচক আন্দোলনের পরিবর্তে ইতিবাচক আন্দোলনই এখন সময়ের দাবি। বিরোধী দলনেতা হিসেবে সূর্যকান্ত মিশ্রও সেই পথ ধরেই হাঁটছেন। অর্থাৎ বুদ্ধ-নিরুপম যেখানে
এসে থেমেছিলেন, সূর্যবাবু সেখান থেকেই শুরু করেছেন।
সিপিএম-এর এক শীর্ষ নেতা বলেন, আসলে কমিউনিস্ট পার্টি একটা সময়ে ক্যাডারভিত্তিক সাংগঠনিক দল ছিল। কিন্তু জ্যোতিবাবুর পর বুদ্ধবাবুই তাঁর ভাবমূর্তি দিয়ে নাগরিক সমাজের অ-বাম একটা বড় অংশকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পর এঁদের অনেকেই সিপিএম-কে পরিত্যাগ করে অন্য পক্ষে যোগ দেন। আজ যখন তাদের ফিরিয়ে আনার কথা হচ্ছে তখন এটা স্পষ্ট যে, তাঁদের উপরে বুদ্ধবাবুর চেয়ে বেশি প্রভাব সিপিএমের অন্য কোনও নেতা অর্জন করতে পারেননি।
সূর্যবাবু বুদ্ধবাবুর ঘনিষ্ঠ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। দিল্লিতে মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের পাশাপাশি বুদ্ধবাবু তাঁকেই পাঠাতেন। বিরোধী দলনেতা হিসেবেও তিনি বেশ ভাল কাজ করছেন বলে দলের একটা বড় অংশের অভিমত। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাজ্য সিপিএমের শীর্ষ স্থানীয় নেতারা মনে করছেন, বুদ্ধবাবু যদি এখন কোনও কারণে সরে যান, তা হলে সাধারণ মধ্যবিত্ত জনসমাজে তার প্রতিক্রিয়া ভাল হবে না।
ভোটে হেরে যাওয়ার পর থেকে এমনিতেই বুদ্ধবাবু নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। প্রকাশ্যে কথা খুব কম বলছেন। তবে পার্টি অফিসে সকাল-বিকেল আসেন। দল যখন যেমন বলে, সে ভাবে জনসভাও করছেন। পার্টি কংগ্রেসের আগে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন একটি টিভি চ্যানেলে। সিপিএমের এক রাজ্য নেতার মন্তব্য, “ঢেউ যখন আসে, তখন বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে নেই। মাথাটা নিচু করে ঢেউকে চলে যেতে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। বুদ্ধবাবুর এই ‘শীত ঘুমের’ মধ্যে একটা সচেতন রাজনীতি আছে। সংবাদমাধ্যমে মুখ দেখতে দেখতে মানুষ ক্লান্ত-বিরক্ত হয়ে পড়ে। তার চেয়ে আড়ালে থেকে প্রস্তুতিপর্ব সারাটাই রাজনৈতিক বিচক্ষণতা।”
তবে এটাও ঠিক যে বুদ্ধবাবু অনেক দিন ধরেই ফুসফুসের সমস্যায় ভুগছেন। কিন্তু দল মনে করে, সেটা এমন অবস্থায় পৌঁছয়নি যে তাঁকে অবসর নিতে হবে। আর তাই আজও শুধু দলের অভ্যন্তরে নয়, জনগণের সামনে নেতা হিসেবে তুলে ধরার ক্ষেত্রেও বুদ্ধবাবু অপরিহার্য। |