তাঁর দল ও সরকারের বিরুদ্ধে বিরূপ প্রচার ঠেকাতে এক দিকে যখন ‘নেট-শাসনে’ উদ্যত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্য দিকে তখন সেই তিনিই জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে তথ্যপ্রযুক্তির দ্বারস্থ।
এগারো মাসের তৃণমূল জোট সরকারের নানা কাজকর্ম নিয়ে বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটে প্রতিবাদে সরব নেট-জনতার একটা অংশ। নানা রঙ্গ-রসিকতাও চলছে পুরোদমে। এমনই এক ব্যঙ্গচিত্র ই-মেল মারফৎ বিভিন্ন লোককে পাঠিয়ে অতি সম্প্রতি গ্রেফতার হন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক। পাশাপাশি রঙ্গ-রসিকতা তথা ‘অশালীন’ প্রচার ঠেকাতে ফেসবুকের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটগুলির দ্বারস্থ হয়েছে সিআইডি।
এটা যদি একটা দিক হয়, তা হলে অন্য দিকটা হল বর্তমান দুনিয়ায় তথ্যপ্রযুক্তিকে যে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়, সেটা রাজ্য সরকার তথা তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব ভালই জানেন। বস্তুত, বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে বিশেষত নতুন প্রজন্মকে কাছে টানতে ইন্টারনেটকে যথেষ্ট পরিমাণে কাজে লাগিয়েছিল তৃণমূল। এ বার বিরূপ প্রচার রুখে পাল্টা জনসংযোগ বাড়াতেও সেই নেটকেই আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেই লক্ষ্যে ঢেলে সাজা হচ্ছে রাজ্য সরকারের নিজস্ব ওয়েব পোর্টাল ‘বাংলার মুখ’-কে। সাধারণ মানুষ যাতে নিজেদের অভাব, অভিযোগ বা পরামর্শ সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করার কথা ভাবা হচ্ছে। যার জন্য চালু করা হতে পারে ‘সিএমও ব্লগ’। পরিকল্পনা রয়েছে একই ভাবে রাজ্যপালকেও সাধারণ মানুষের ‘নাগালে আনার’। সে ক্ষেত্রে, রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ স্তরের সঙ্গে একান্ত আলাপ হয়তো সম্ভব হবে না। কিন্তু অন্তত নেট মারফত নিজেদের বক্তব্য পৌঁছে দেওয়ার পথ খুলে যাবে আমজনতার সামনে।
এ দেশের মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে নেট-দুনিয়ায় অতি সক্রিয় গুজরাতের নরেন্দ্র মোদী। নিয়মিত টুইট করেন তিনি। ফলে টুইটারের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের একটা পথ আমজনতার রয়েছে। এ বার সরকারি ওয়েবসাইটকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের পথ খুলতে চাইছেন মমতাও। |
তবে শুধু সেটাই নয়, সাধারণ মানুষের সামনে বিভিন্ন সরকারি পরিষেবা পাওয়ার পথ মসৃণ করতেও ‘বাংলার মুখ’-কে ব্যবহার করতে চায় রাজ্য। খোলনলচে বদলাতে চায় ওই পোর্টালের। এবং এ জন্য দ্বিমুখী কৌশল নিচ্ছে তারা। এক দিকে, চেষ্টা করা হচ্ছে ওয়েবসাইট থেকে ফর্ম, শংসাপত্র-সহ বিভিন্ন তথ্য পরিষেবা পাওয়ার প্রক্রিয়া আরও মসৃণ করার। আবার অন্য দিকে, তথ্য সংকলন ও তা পরিবেশনের ক্ষেত্রে মাথায় রাখা হচ্ছে ‘টার্গেট অডিয়েন্স’-এর কথা। অর্থাৎ আগাম ভেবে দেখা হচ্ছে কোন ধরনের তথ্য পরিষেবা কার প্রয়োজন হতে পারে। আর সেই অনুযায়ী তথ্য ভাণ্ডারকে ছোট ছোট ভাগে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। যাতে প্রয়োজনীয় তথ্য খুঁজে পাওয়া সহজ হয়। তা সে তিনি সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীই হোন, বা এ রাজ্যে পা রাখতে চাওয়া পর্যটক।
যেমন, এ রাজ্যে ব্যবসা করতে কী কী নথি প্রয়োজন, বিভিন্ন ছাড়পত্র পেতেই বা কোন দফতরে কার সঙ্গে কথা বলতে হবে এ সব খুঁটিনাটি নিয়েই তৈরি হবে সম্পূর্ণ আলাদা একটি বিভাগ। যাতে নেটে হেঁটে এক লপ্তে সব প্রয়োজনীয় তথ্যই হাতের নাগালে পেতে পারেন সম্ভাব্য লগ্নিকারীরা।
তথ্য পরিষেবার পাশাপাশি রাজ্যের ভাবমূর্তি নির্মাণের কাজেও (ব্র্যান্ডিং) সরকারি ওয়েব পোর্টালটিকে ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে তা কী ভাবে করা হবে, তা এখনও আমলাদের বিবেচনাধীন।
‘বাংলার মুখ’ তৈরি করেছে উপদেষ্টা সংস্থা প্রাইসওয়াটারহাউজ কুপার্স। পোর্টাল ঢেলে সাজার এই প্রকল্প নিয়ে সম্প্রতি তথ্য ও সংস্কৃতি এবং তথ্যপ্রযুক্তি দফতরের সঙ্গে বৈঠকও করেছে সংস্থাটি। তবে এ নিয়ে এখনই মুখ খুলতে চায় না তারা। প্রসঙ্গত, দেশে প্রথম ই-গভর্ন্যান্স চালু হয়েছিল এ রাজ্যেই। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, তা সত্ত্বেও মূলত প্রশাসনিক ঢিলেমির কারণেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল ‘বাংলার মুখ’। অথচ গ্রামের বহু মানুষও কিয়স্কের মাধ্যমে নেট ব্যবহার করে সরকারি তথ্য জানতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন সরকারি দফতরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ওই তথ্য পাওয়ার পথেই অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই সাধারণ মানুষের দরজায় এই তথ্যপরিষেবার সুফল পৌঁছে দিতে উন্নততর প্রযুক্তির পাশাপাশি তথ্যের পর্যাপ্ত জোগানও জরুরি হবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। |