মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে রাজ্য সরকার যখন বিতর্কে, তখনই সিপিএমকে ‘ঘৃণা’ করে এবং তাদের সঙ্গে ‘সামাজিক সম্পর্ক’ না-রাখার কথা বলে নতুন বিতর্ক তুলে দিলেন রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী তথা উত্তর ২৪ পরগনার তৃণমূলের পর্যবেক্ষক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক।
তবে ওই ‘বিতর্কে’ জ্যোতিপ্রিয় ‘পাশে’ পেয়েছেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক (তৃণমূলে অঘোষিত ‘দু’নম্বর’) তথা রেলমন্ত্রী মুকুল রায়কে। জ্যোতিপ্রিয়র মতোই মুকুলও মনে করেন, সিপিএমের বিরুদ্ধে ‘ঘৃণা’ জাগিয়ে রাখতে হবে।
জ্যোতিপ্রিয়র বক্তব্য ইতিমধ্যেই রাজ্য-রাজনীতিতে তোলপাড় ফেলেছে। রাজনীতির কারবারিরা মনে করছেন, রাজ্যের ক্ষমতায় থাকাকালীন সিপিএম যেমন পারিবারিক এবং সামাজিক বিষয়ে নাক গলাত এবং আমজনতার সামাজিক জীবন ‘নিয়ন্ত্রণে’র চেষ্টা করত, তৃণমূলও সেই পথেই হাঁটছে। বস্তুত, সিপিএম বিষয়টিকে একটি ‘প্রাতিষ্ঠানিক রূপ’ দিয়েছিল। বিরোধীদের বিরুদ্ধে দলীয় কর্মীদের ‘এককাট্টা’ রাখতেই সিপিএম ওই ‘ফরমান’ জারি করত। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা সকলেই (দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ) সামাজিকতাকে গুরুত্ব দেন। পুজো-ঈদ-বিয়েবাড়ির মতো বিভিন্ন ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে ‘জনসংযোগ’ করে থাকেন। সাধারণত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেব করা হয় না। |
সেই পরিপ্রেক্ষিতেই জ্যোতিপ্রিয়র বক্তব্য ‘ভিন্ন মাত্রা’ পেয়ে গিয়েছে। তা আরও ‘আলোড়ন’ তুলেছে সময় বিচারে। যে সময়ে সংবাদমাধ্যমের মধ্যে ‘বিভাজন’জনিত সরকারি নির্দেশ দিয়ে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে মুখ্যমন্ত্রী ও রেলমন্ত্রীকে নিয়ে রঙ্গ-চিত্র সম্পর্কে কঠোর মনোভাব নিয়ে রাজ্য সরকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ‘খর্ব’ করার দায়ে রাজ্যবাসীর একাংশের কাছে কাঠগড়ায়, তখনই জ্যোতিপ্রিয়র ওই মন্তব্য।
গত রবিবার উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় দলীয় কর্মীদের কাছে এক ঘরোয়া সভার খাদ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “সিপিএম নেতা-কর্মীদের বাড়িতে নিমন্ত্রণে (মতান্তরে, বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে) যাবেন না। কোনও সামাজিক সম্পর্ক রাখবেন না। পাশে বসবেন না। এরা ঘৃণিত বস্তু। এদের ঘৃণা করতে শিখুন!”
দলের রুদ্ধদ্বার সভায় খাদ্যমন্ত্রীর ওই বক্তব্য প্রকাশ্যে আসতেই বিতর্ক শুরু হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, তবে কি এটা তৃণমূলের দলীয় ‘নীতি’?
মঙ্গলবার জ্যোতিপ্রিয় অবশ্য নিজেই বলেন, “এটা কি কখনও দলের নীতি হতে পারে!” তা হলে তিনি কেন তৃণমূল কর্মীদের কাছে ওই ‘অনুরোধ’ জানালেন? মন্ত্রীর বক্তব্য, “হাবরায় দলের দু’-চারজন লোকের গতিবিধি দেখে তাদের সতর্ক করতেই বলেছি। আমি চাই না, সিপিএমকে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলায় কোনও ফাঁক থাকুক। নইলে পরবর্তী সময়ে প্রতিশোধ নিতে গেলে মন দুর্বল হয়ে যাবে।” কিন্তু ঘটনা হল, জ্যোতিপ্রিয় আগেও দলীয় সভায় এই ধরনের মন্তব্য করেছেন। মার্চ মাসের গোড়ায় দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট ও উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন কর্মী সম্মেলনে এমন ‘ফরমান’ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বর্তমান সময়ে তাঁর ওই বক্তব্য আলাদা ‘তাৎপর্য’ পেয়ে গিয়েছে। বিরোধী শিবির তো বটেই, আলোড়ন পড়েছে শাসক শিবিরেও।
তবে জ্যোতিপ্রিয়র দাবি, ‘প্রতিশোধ’ বলতে তিনি ‘বদলা’ বা ‘খুনোখুনির’ কথা বলেননি। সিপিএমের ‘রাজনৈতিক’ মোকাবিলার কথা বলেছেন। মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর, ওই বিষয়ে মমতাও তাঁকে ‘নির্দেশ’ দেননি। তিনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই ওই কথা বলেছেন। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পরেও দলনেত্রী তাঁকে কিছু বলেননি বলেই মন্ত্রীর দাবি। দলের অন্দরে জ্যোতিপ্রিয়র ব্যাখ্যা ওই কথা তিনি প্রকাশ্যে বলেননি। বলেছেন দলের অন্দরে। মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, “ফুটবল কোচেরা যেমন দলের খেলোয়াড়দের তাতাতে ড্রেসিংরুমে ভোকাল-টনিক’ দেন, মন্ত্রীও তেমন দলের কর্মী সম্মেলনে কর্মীদের উজ্জীবিত করতে কিছু কথা বলেছেন। তার মানে তো সেটা দলের নীতি হয়ে যায় না!”
তবে জ্যোতিপ্রিয়র ‘পাশে’ দাঁড়িয়েছেন মুকুল। ওই বক্তব্য দলের ‘নীতি’ নয় জানিয়েও তৃণমূলের অন্যতম শীর্ষনেতার বক্তব্য, “দলের ভিতরে বা কর্মিসভায় কেউ তাঁর মত দিতেই পারেন। বিরোধী দল সম্পর্কে ক্রোধ ও ঘৃণার আগুনকে নিভতে দেওয়া যায় না। দত ৩৪ বছরে সিপিএমের হাতে আমাদের ৩৫ হাজার স্বজন-আত্মীয় খুন হয়েছেন। প্রায় ১৩ হাজার মহিলা ধর্ষিতা হয়েছেন। এটা তো ভুলে গেলে চলবে না!” বস্তুত, মুকুলের অভিযোগ, একদা রাজ্যে কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে দলীয় কর্মীদের মধ্যে ‘ঘৃণা জাগাতে’ সিপিএম নেতারা নিরন্তর প্রচার করতেন। তাঁর কথায়, “১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত সিপিএম-কে কিন্তু রাজ্য থেকে মুছে দেওয়া হয়নি! সে সময়ে সিপিএম নেতারা দলীয় কমরেডদের বলতেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকলে কেউ পিতার শেষকৃত্যে থাকতে পারবে না, সন্তানের জন্মের সময়ে কংগ্রেস কাউকে স্ত্রীয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে দেবে না! এ ভাবেই ১৯৭৭ সালে মানুষের ঘৃণা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশে কংগ্রেসকে ক্ষমতা থেকে সরতে হয়েছিল। ফলে সিপিএমের কুকীর্তি সম্পর্কে ঘৃণার মনোভাবটা আমাদের কর্মীদের রাখতে হবে। অতীত ইতিহাস মনে রাখতে হবে।” সেই ‘ইতিহাস’ ঘেঁটেই জ্যোতিপ্রিয়র বক্তব্য, ‘সিপিএমের অত্যাচারে’ আটের দশক থেকে বর্ধমানের মন্তেশ্বরে তাঁর গ্রামের বাড়িতে যেতে পারেননি। তিনি। যেতে পেরেছেন গত বছর, রাজ্যে ‘পরিবর্তনে’র পর!
তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা বিধায়ক নির্মল ঘোষ, জেলায় তৃণমূলের সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সৌগত রায়ও জানিয়েছেন, দলে এমন কোনও নীতি নেওয়া হয়নি। সৌগতবাবু বলেন, “দলে এমন নীতি নেওয়া হয়েছে বলে জানা নেই।” নির্মলবাবুর কথায়, “দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের থেকে এমন কোনও নির্দেশ পাইনি।” তৃণমূলের একাংশ যেমন বলেছেন, এমন ‘বিতর্কিত’ মন্তব্য না-করে মন্ত্রীর উচিত দফতরের কাজে আরও মনোনিবেশ করা। তাতেই দল বেশি ‘উপকৃত’ হবে। আর বিরোধী সিপিএমের নেতা সুজন চক্রবর্তীর কথায়, “এটা বাংলার সংস্কৃতির বিরোধী। এটা চলতে পারে না!” বিষয়টিকে ‘অশনি সঙ্কেত’ বলে অভিহিত করে সুজনবাবু বলেন, “এটা স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব।” সরকারের জোটশরিক কংগ্রেসের নেতা আব্দুল মান্নান বলেন, “প্রথমে শুনে মনে হয়েছিল পাগলের প্রলাপ। পরে দেখলাম, রাজ্যের এক দায়িত্বশীল মন্ত্রী ওসব বলছেন!”
জ্যোতিপ্রিয়র অবশ্য দাবি, ‘‘আমি মোটেই সামাজিক বয়কটের কথা বলিনি। বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠান নিয়েও আমি কিছু বলিনি। আমার মন্তব্যের অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে।” তবে সিপিএমকে ‘ঘৃণা’ করার কথা বলে যে তিনি কোনও ভুল করেননি, তা জানিয়ে মন্ত্রীর বক্তব্য, “আমি আমাদের দলের কর্মীদের এটা অবশ্যই বলেছি যে, চায়ের দোকান বা বাজারে সিপিএমের লোকেদের সঙ্গে আড্ডা না-মারতে। ওরা কোনও অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালে না-যেতে!” |