প্রবন্ধ ২...
বরাদ্দ তো হল, কিন্তু লক্ষ্য?
ভারতে বিজ্ঞান গবেষণার ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল। কোনও সন্দেহ নেই, আমরা নতুন নতুন উচ্চতায় পৌঁছব, নতুন দিগন্ত আবিষ্কার করব, ক্রমশ আরও বেশি সংখ্যায় তরুণ-তরুণীরা কেরিয়ার হিসেবে বিজ্ঞানকে বরণ করবে। পরিবর্তন ইতিমধ্যেই এগোচ্ছে ভালর দিকে।
এ দেশের বিজ্ঞানচর্চা সম্পর্কে এমন পলিটিকালি-কারেক্ট মন্তব্য কার হতে পারে? অনুমানের জন্য প্রাইজ নেই; ভবিষ্যতের এমন রঙিন স্বপ্ন রাজনীতিক ভিন্ন আর কে রচনা করতে পারেন? গালভরা বুলি আওড়াতে নেতা-নেত্রীদের ট্যাকসো লাগে না। আর, স্বপ্নের ফেরিওয়ালা না হলে আম আদমির ভোটও পাওয়া যায় না। ভোট ছাড়া রাজনীতির আর আছেটা কী?
ওই মন্তব্য এক জন রাজনীতিকের তো নিশ্চয়ই, তবে তিনি আবার এক জন প্রশাসকও বটেন। বস্তুত, তিনি ভারতের সবচেয়ে বড় প্রশাসক। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাঁর মুকুটে এক নতুন পালক। এখন তিনি আবার এ দেশে বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশন-এর জেনারেল প্রেসিডেন্ট। অর্থনীতিবিদ হিসেবে তিনি যতটা না বিজ্ঞানী, মুকুটে ওই নতুন পালকের সুবাদে তিনি তার চেয়েও বড়। হ্যাঁ, ওই মন্তব্য প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের। ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞান পত্রিকা ‘সায়েন্স’-এর এডিটর-ইন-চিফ ব্রুস অ্যালবার্টস ও তাঁর দুই সহকর্মীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওই স্বপ্ন রচনা করেছেন তিনি।
তবে কিনা মনমোহন একটু অন্য রকম রাজনীতিক। কাল কী হবে, সে কথা না ভেবে, কেবল আজ জনমোহন হয়ে থাকার কথা ভাবেন না। ১৯৯০-এর দশকে অর্থমন্ত্রিত্ব থেকে শুরু করে ২০০৪ সালে প্রধামন্ত্রিত্বে পৌঁছনোর পরেও ওই মনোভাব বজায় রেখে চলেছেন। তাই হয়তো সাক্ষাৎকারে ওই মন্তব্য করেও একটা চেষ্টা চালিয়েছেন নিজেকে আম রাজনীতিক থেকে দূরে রাখার। ওই মন্তব্যের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন, ‘আশাবাদী হতেই হয়। গরিব দেশে আশাবাদী না হলে সমৃদ্ধির যে কর্মকাণ্ড বাকি আছে, তার বিশালতা ভেবে দিশেহারা হয়ে পড়ব আমরা।’ মনে পড়েছে, কে যেন বলেছিলেন, ‘ইউ জাস্ট ইউজ দি ফিউচার টু এসকেপ দি প্রেজেন্ট।’ বর্তমানের ব্যর্থতা ঢাকতে চাও? ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন দেখো।
পশ্চিমী প্রচার মাধ্যমে গত কয়েক বছর ধরে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতি নিয়ে শোরগোল চলছে। চিনের পাশাপাশি ভারতও নাকি তাক-লাগানো সমৃদ্ধির দিকে ধাবমান। বাণিজ্যে যদি ভারতের উন্নতি লক্ষণীয় হয়, তা হলে বিজ্ঞান গবেষণাতেও হবে পশ্চিমী প্রচার।
সেই ধারণায় নতুন ইন্ধন জুগিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং, বছরের প্রথম সপ্তাহে ভুবনেশ্বরে আয়োজিত ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস-এর বার্ষিক অধিবেশনের ভাষণে। গত কয়েক বছরে সরকার বিজ্ঞানের খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে চলেছে, ফি-বছর প্রায় ২৫ শতাংশ হারে। কিন্তু সেটাও যথেষ্ট নয়। উন্নত দেশে যেখানে বিজ্ঞানে খরচ হয় মোট জাতীয় আয়ের ২.৩ শতাংশ, চিন খরচ করে ১.৮ শতাংশ, সেখানে ভারতে তা মাত্র ১ শতাংশের কাছাকাছি। হয়তো এই প্রেক্ষিত মনে রেখে বিজ্ঞান কংগ্রেসে মনমোহন বলেন, ‘গত কয়েক দশকে বিজ্ঞানের দুনিয়ায় ভারতের তুলনামূলক অবস্থান নিম্নগামী। আমাদের ছাপিয়ে গেছে চিন। অনেক ব্যাপারে ও-দেশ আমাদের থেকে এখন অনেক এগিয়ে।’ অবশ্য, বাস্তব পরিস্থিতি মেনে নেওয়ার পাশাপশি আরও এক ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিক যোজনায় অর্থাৎ, ২০১২-১৩ আর্থিক বছর থেকে বিজ্ঞানের খাতে বরাদ্দ আরও বাড়াচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই যোজনার শেষ বছরে ২০১৭ সালে ওই বরাদ্দ দাঁড়াবে মোট জাতীয় আয়ের ২ শতাংশ। অর্থাৎ, আজকের বরাদ্দের দ্বিগুণ। এবং আজকের চিনের হিসেবের চেয়ে বেশি। কয়েকটি বিশেষ প্রকল্পে সমর্থনের ঘোষণাও করেন প্রধানমন্ত্রী। যেমন, বেঙ্গালুরুতে ৫০০০ কোটি টাকার সুপার কম্পিউটার গবেষণা, তামিলনাড়ুর থেনি জেলায় ১৩৫০ কোটি টাকার নিউট্রিনো ল্যাবরেটরি, আবহাওয়ার নির্ভুল পূর্বাভাস পেতে ৩৫০ কোটি টাকার গবেষণা ইত্যাদি।
কিন্তু বাস্তব? তা যে তত সুখের নয়। ২০১২-১৩ সালের বাজেটে অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় যে বিজ্ঞানে বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছেন। না, গত কয়েক বছরের তুলনায় কমাননি। তবে, ইদানীং ফি-বছর যে বরাদ্দ ২৫ শতাংশ হারে বাড়ছিল, সে হারে এ বার বাড়াননি। মাত্র একটা বিভাগে বরাদ্দ বাড়িয়েছেন অকল্পনীয় হারে মহাকাশ গবেষণায়। বরাদ্দ বেড়েছে ৫২ শতাংশ। তবে ওই বৃদ্ধির মধ্যে কিন্তু ঢুকে আছে ২০১২-১৩ আর্থিক বছরে অব্যবহৃত বিশাল অঙ্কের টাকা। আর অন্য খাতে? সেখানে বৃদ্ধি ১.৮ শতাংশ থেকে ১৭.৯ শতাংশ (তালিকা দেখুন)। সরকার সাফাই গাইবে, তাতে কী, বরাদ্দ বাড়ানো তো হয়েছে। উত্তর: না, বাস্তব বিচারে পরিস্থিতি ভিন্ন। দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার বছরে ৭ শতাংশ। তা হলে, ১.৮ শতাংশ বরাদ্দবৃদ্ধি তো বাদই দিচ্ছি, ১৭.৯ শতাংশ বাজেট বাড়ানোরই বা কী পড়ে থাকে?
বাজেট বরাদ্দের যে ছবি পেশ করলাম, তা হয়তো বা সাময়িক। হয়তো পরের আর্থিক বছরে বরাদ্দ বাড়বে। সত্যিটা এই যে, বিনিয়োগের ব্যাপারে হালফিল সরকার গুরুত্ব দিয়েছে বিজ্ঞানকে। এর পর আসে সেই চূড়ান্ত প্রশ্নগুলো। বরাদ্দ খরচ করা হবে কোন লক্ষ্যে? বরাদ্দ-বৃদ্ধি থেকে উপকার সব সময়ই মেলে, কিন্তু সেই লাভ কি অভিপ্রেত লক্ষ্যে? প্রশ্নগুলোর উত্তর ভীষণ জরুরি। নইলে অর্থব্যয় শুধু বক্তৃতার বিষয় হয়ে থাকে।
বিজ্ঞানের পঠন-পাঠন নতুন খাতে বওয়ানোর জন্য স্বাধীনতার পর জওহরলাল নেহরু ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি প্রতিষ্ঠায় জোর দিয়েছিলেন। দেশ গড়ার কাজে প্রচুর প্রযুক্তিবিদ চাই, তাই আই আই টি প্রতিষ্ঠা, যার প্রবেশিকা পরীক্ষা আমেরিকার হার্ভার্ড কিংবা ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি-র এন্ট্রান্সের চেয়েও কঠিন। এ হেন আই আই টি দেশ গড়ায় কতটা কাজে লেগেছে? আই আই টি-র সংখ্যা ৭ থেকে বাড়িয়ে ১৬-য় নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ এখন দেশ জুড়ে। অজুহাত? দেশে মেধাবী ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে।
প্রযুক্তি শিক্ষার লোভ এড়িয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা যাতে মৌল বিজ্ঞান পড়তেও আগ্রহী হয়, সে জন্য একেবারে নতুন সিলেবাস রচনা করে গত পাঁচ বছরে দেশের নানা জায়গায় খুলেছে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার)। ভাল ছাত্রছাত্রীর জন্য উন্নত মানের শিক্ষা। ভাল।
কিন্তু এর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা? যে কোনও উন্নত দেশে যা বিজ্ঞান শিক্ষা এবং গবেষণায় গর্বের বিষয়? হ্যাঁ, সরকার সে দিকে নজর দিয়েছে বইকী। এখন দেশে ৯ জন যুবকের ১ জন কলেজমুখী। আগামী দশ বছরে যাতে ৩ জনের ১ জন কলেজে যায়, তার ব্যবস্থা করতে চায় সরকার। গড়তে চায় অনেক নতুন বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সেগুলোতে শিক্ষার মান? না, তা উন্নত করার কোনও বড় উদ্যোগ সরকারের নেই। থাক না ইউনিভার্সিটিগুলো আদার ব্যাকওয়ার্ড কাস্ট হয়ে। বৈষম্য? ওহ্, তার তো সোজা সমাধান আছেই। ভবিষ্যতে কখনও চাকরিতে একটা কোটা সিস্টেম চালু করলেই তো মুশকিল আসান!
মূল সমস্যা বোধহয় এই যে, আমাদের টনক নড়ে দেরিতে। বছর ১৫-১৬ আগে কলকাতার কিছু বিজ্ঞানের অধ্যাপক গবেষক একটা ট্রেন্ড লক্ষ করে ব্যথিত হয়েছিলেন। মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে চাকরির লোভে মৌলবিজ্ঞান ছেড়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে দৌড়োচ্ছে। এ ভাবে চললে মৌলবিজ্ঞানে উঁচু মানের গবেষক মিলবে না। এই উদ্বেগ থেকে অধ্যাপক গবেষকেরা কেউ কেউ নিজের উদ্যোগে শুরু করেছিলেন এক কাজ। মৌলবিজ্ঞানের রহস্যে স্কুলপড়ুয়াদের আকৃষ্ট করতে বক্তৃতা সেমিনার। তেমন সাড়া না পেয়ে এক সময় বন্ধ হয়ে গেছে সে-সব। দ্রুত চাকরির হাতছানি বড় শক্তিমান। তার সঙ্গে পাল্লা দেয় কে?
এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। ওই হাতছানি আর ততটা লোভনীয় নয়। এতদিনে ঘুম ভেঙেছে সরকারের। মৌলবিজ্ঞানে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের টানতে চালু হল উৎসাহদান প্রকল্প। ইনোভেশন ইন সায়েন্স পারসুট ফর ইনস্পায়ার্ড রিসার্চ। সংক্ষেপে, ‘ইনস্পায়ার’। আছে মোটা বৃত্তি। আর হ্যাঁ, সরকারি টাকায় বক্তৃতা সেমিনার। একটু দেরি হয়ে গেল যে।
এ দিকে আর এক গেরো। মৌলবিজ্ঞান পড়লেই সবাই সত্যেন বোস মেঘনাদ সাহা হবে, এমন তো গ্যারান্টি নেই। তা হলে? আজীবন গবেষক হতে পারবে না যারা, তারা করবে কী? কলেজে অধ্যাপনা? তা ভাল, কারণ মাইনে মোটা। না, ভাল নয়, কারণ স্থায়ী চাকরি জুটছে না। রাজ্য সরকারের ভাঁড়ে মা-ভবানী। তাই চাকরি বলতে কেবল পার্ট-টাইম। মাইনে দশ হাজার টাকা।
নুন এল বটে। তবে, পান্তা যে শেষ!
বাজেটে বিজ্ঞান (কোটি টাকার হিসেবে)
বিভাগ ২০১১-১২
সালের বরাদ্দ
২০১২-১৩
সালের বরাদ্দ
শতকরা বৃদ্ধি
পরমাণু শক্তি ৬,৭২৪ ৭,৬৫১ ১৩.৮
স্বাস্থ্য ৭৭০ ৯০৮ ১৭.৯
বিজ্ঞান প্রযুক্তি ২,৬০৬ ২,৮৭৩ ১০.৩
কারিগরি গবেষণা ৩,২১৭ ৩,৪৮৪ ৮.৩
জৈব প্রযুক্তি ১,৩৭৭ ১,৫০০ ৯.০
কৃষি গবেষণা ৫,০০৮ ৫,৩৯২ ৭.৭
সুমদ্র বিজ্ঞান ৬৯৯ ৭১৩ ১.৮


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.