ভারত হইতেই এক সময়ে বুদ্ধের অহিংসার বাণী ছড়াইয়া পড়িয়াছিল বিশ্বের অন্যান্য দেশে। সম্রাট অশোক তাঁহার রাষ্ট্রদূতদের পাঠাইয়াছিলেন শান্তির দূত রূপে, সেই দান এখনও স্বীকৃত হইয়া থাকে। ইদানীং ভারত হইতে রফতানি হইতেছে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এক ভাব, তাহা নারী হিংসা। বিজাতীয়, বিধর্মী নারী নহে, নিজের গর্ভের কন্যার প্রতি হিংসা, তাহাকে জন্মের পূর্বেই নিঃশেষ করিয়া দিবার ইচ্ছা ভারতীয়রা বহন করিয়া লইয়া চলিতেছে পাশ্চাত্যের নানা দেশে। কানাডায় একটি সমীক্ষায় সম্প্রতি ধরা পড়িয়াছে, সে দেশে বসবাসকারী ভারতীয় মহিলাদের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় সন্তান পুত্র হইবার হার অন্যান্য দেশের মহিলাদের তুলনায় বেশি, এবং এই পার্থক্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। ইহাতে স্পষ্ট হইয়া যাইতেছে যে, ভারতীয় মহিলারা গর্ভস্থ শিশুর লিঙ্গ পরীক্ষা করাইতেছেন, এবং শিশুটি পুত্র না হইলে গর্ভনাশ করিতেছেন। ভারতে বহু পূর্বেই একাধিক সমীক্ষায় স্পষ্ট, শিক্ষিত এবং ধনী পরিবারগুলি চিকিৎসা-প্রযুক্তির সুযোগ লইয়া ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ণয় করিতেছে, তাই এই পরিবারগুলিতে কন্যাসন্তান জন্মের হার দরিদ্র পরিবারগুলির তুলনায় কম। ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ণয় বিষয়ে নানা আইন করিয়াও লাভ হয় নাই, চিকিৎসকদের উপর নানা প্রকার সতর্কতামূলক নিয়ম চাপাইয়াও চিত্র বদলায় নাই। ২০১১ সালের জনগণনায় ধরা পড়িয়াছে, ছয় বৎসরের কম বয়সী প্রতি হাজার শিশুপুত্রের সহিত জন্মাইতেছে কেবল ৯১৪টি শিশু কন্যা। কন্যাদের অন্তর্ধান অব্যাহত, বিবেক কিংবা বিধিনিষেধ, কিছুই সেই স্রোত আটকাইতে পারে নাই। এখন ভারতের লজ্জা বিদেশেও ফুটিয়া বাহির হইতেছে। এক সময়ে আশা হইত, ভারতের আদর্শ অন্য দেশগুলিও অনুসরণ করিবে। এখন ভয় হয়, যদি বাস্তবিকই বিদেশীরাও ভারতীয়দের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেন তাহা হইলে গোটা বিশ্বের সমাজে বৈষম্যের শিকড় আরও গভীর হইবে। ভারতীয়দের মনোজগতে এই শিকড় কত গভীর, তাহা এই সমীক্ষা হইতে স্পষ্ট হইল। ইহা মনে করা অস্বাভাবিক নহে যে, ভারতীয় সমাজে পরিবারের বধূটির উপর পুত্র সন্তান প্রসব করিবার চাপ অত্যধিক হয়, নির্যাতনও ঘটিয়া থাকে, তাহাকে ভয়ে মুখ বুজিয়া থাকিতে হয়। অল্পবয়সী দম্পতি পরিবারের বয়স্কদের মত উপেক্ষা করিতে না পারিয়া গর্ভস্থ কন্যাসন্তানের বিনাশ মানিয়া লয়। কিন্তু প্রবাসী দম্পতির ক্ষেত্রে যৌথ পরিবারের চাপ অতখানিই প্রবল হওয়ার কথা নহে। তাহাদের স্বাধীন জীবনযাত্রার জন্য সিদ্ধান্ত লইবার ক্ষমতাও যথেষ্ট। তৎসত্ত্বেও যদি তাঁহারা অধিক পুত্র সন্তানই কামনা করিয়া থাকেন, তাহার অর্থ, নারীদের অবমূল্যায়ন তাঁহারা আত্মীকরণ করিয়াছেন। বৈষম্য সমাজে তখনই গভীর হইয়া বসে, সমাজব্যবস্থার নির্ধারক হইয়া ওঠে, যখন তাহাকে মান্যতা দেওয়া হয়। সমাজের কোনও কোনও গোষ্ঠী যে বাস্তবিক নিন্দিত, নিয়ন্ত্রিত হইবার যোগ্য, তাহাদের ভার অন্যেরা বহিতেছে বলিয়া তাহাদের চিরকৃতজ্ঞ থাকিতে হইবে, এই চিন্তাটি অপমানিত মানুষগুলিও আত্মস্থ করিয়া নেয়। তাই শত অবিচার, অত্যাচার হইলেও তাহারা প্রতিকারের কথা চিন্তা করে না। পশ্চিমে প্রবাসী ভারতীয় মহিলারা শিক্ষিত, সচেতন নহেন, এমন নহে। তৎসত্ত্বেও তাঁহারা মনে করেন, কন্যা সন্তান অভিপ্রেত নহে। বিশ্বায়ন এই সংকীর্ণতা দূর করিতে পারে নাই। |