একটি বিরুদ্ধ ভোট। প্রশ্ন অনেক। পার্টি কংগ্রেস শেষ হওয়ার পরে সিপিএমের অন্দরে ঘুরপাক খাচ্ছে এখনও সেই সব প্রশ্ন।
দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের সমাপ্তি ভাষণ থেকে সীতারাম ইয়েচুরির বক্তব্য, সবেতেই উঠে এসেছে তরুণ প্রজন্মকে তুলে আনার প্রসঙ্গ। কিন্তু সেই সিপিএম-ই যখন ৮৯ জনের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি তৈরি করেছে, তাতে তরুণ প্রজন্মের মুখ প্রায় নেই-ই! দু’টি জায়গা এখনও শূন্য। নতুন যে ১৩ জন কমিটিতে ঢুকেছেন, তাঁদের ন্যূনতম গড় বয়স প্রায় ৬০! বিপর্যয় মোকাবিলা করে নতুন যুগের সিপিএম গড়ব অথচ সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক কমিটিতে তারুণ্যের প্রতিনিধি রাখব না এই বৈপরীত্যের প্রতিবাদেই প্যানেলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন তাপস সিংহ। মতামত জানাতে বিরত ছিলেন চার জন। পার্টি কংগ্রেস শেষে প্রতিনিধিরা রাজ্যে ফিরে যাওয়ার পরেও এই নিয়ে চর্চা অব্যাহত রয়েছে এবং দলের অন্দরেই তৈরি হয়েছে ক্ষোভ।
তাপসবাবু যে ডিওয়াইএফআইয়ের সাধারণ সম্পাদক, সেই যুব সংগঠনের সদস্যসংখ্যা এই মুহূর্তে সিপিএমে দ্বিতীয় বৃহত্তম। পার্টি কংগ্রেসেই পেশ-হওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, দলের গণসংগঠনগুলির মধ্যে সব চেয়ে বেশি সদস্য এখন কিষাণ সভার ২ কোটি ১৯ লক্ষ ৯২ হাজার ৯০৩। তার পরেই যুব সংগঠন ১ কোটি ৭৫ লক্ষ ২০ হাজার ১৩৯। এ ছাড়াও ছাত্র সংগঠনের সদস্য ৪১ লক্ষ ৭৭ হাজার ৬৯৫। সামগ্রিক ভাবে দল হিসাবে সিপিএমের সদস্য সংখ্যার সর্বশেষ হিসাব ১০ লক্ষ ৪৪ হাজার ৮৩৩। দলের মধ্যে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও নবনির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটিতে যুব ও ছাত্র ফ্রন্টের কোনও প্রতিনিধি না-থাকা পশ্চিমবঙ্গ-সহ নানা রাজ্যেই সিপিএমের সংগঠনে বিস্ময় এবং ক্ষোভ তৈরি করেছে।
কেন্দ্রীয় কমিটিরই একাংশের বক্তব্য, কোঝিকোড়ে তাপসবাবু যা করেছেন, ১৯৯৮ সালে কলকাতা পার্টি কংগ্রেসে তা-ই করেছিলেন বৃন্দা কারাট। তাঁদের মতে, নতুন কমিটিতে পর্যাপ্ত মহিলা না-থাকায় প্যানেলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন বৃন্দা। তবে তফাত বলতে, বৃন্দা নিজেও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন বলে নিজের নাম প্রত্যাহার করেছিলেন, যা তাপসবাবুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এর পরের ইতিহাস হল, ২০০২ সালের হায়দরাবাদ পার্টি কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটিতে ফেরেন বৃন্দা (দলের একাংশের বক্তব্য, এর মাঝের সময়ে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ এবং জ্যোতি বসুকে ‘হস্তক্ষেপ’ করতে হয়েছিল) এবং ২০০৫-এর দিল্লি পার্টি কংগ্রেস থেকে পলিটব্যুরোর সদস্য। সেই কংগ্রেসেই তাঁর স্বামী প্রকাশ সাধারণ সম্পাদক হন। দলের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, কেন্দ্রীয় কমিটিতে ‘বৈষম্যে’র বিরুদ্ধে বৃন্দার একটি ভোট যে ফল এনেছিল, কোঝিকোড়ের একটি ভোট কি তা-ই পারবে?
দলের তরুণ অংশ প্রশ্ন তুলছেন, ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ, এম বাসবপুন্নাইয়ারা যখন প্রকাশ-সীতারামদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আনেন, তখন তাঁরা মধ্য-তিরিশ। সৈফুদ্দিনও কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসেন তরুণ বয়সে। এখন কারাটেরা তা হলে নিজেদের অতীতকেই ‘অগ্রাহ্য’ করছেন কী করে? কারাটেরাই বয়সের কারণ দেখিয়ে অচ্যুতানন্দনকে পলিটব্যুরোয় নেননি। তা-ই যদি হয়, তা হলে তরুণ মুখ তুলে আনতে আপত্তি কোথায়? সিপিএমের এক যুব নেতার ক্ষোভ, “হতে পারে, এখনকার যুব ও ছাত্র ফ্রন্ট দলের ভিতরের সমীকরণে অনেক বেশি ইয়েচুরি-ঘনিষ্ঠ। তাই তাদের কোণঠাসা করা হচ্ছে কি না কে জানে! তবে যে কারণেই হোক, খারাপ দৃষ্টান্ত তৈরি হচ্ছে!”
এ বারের পার্টি কংগ্রেসে মহারাষ্ট্রের নরসায়া আদম, কর্নাটকের জি ভি শ্রীরাম রেড্ডি, অন্ধ্রপ্রদেশের এস বীরাইয়া বা ঝাড়খণ্ডের জি কে বক্সীর বক্তব্য নজর কেড়েছিল। পরে তাঁরা কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। কিন্তু তাঁরা কেউই বয়সে ‘তরুণ’ নন। কেরলের নেত্রী কে কে শৈলজা এঁদের তুলনায় বয়ঃকনিষ্ঠ ঠিকই। তবে তাঁকেও ‘তরুণী’ বলা যায় না। এ রাজ্য থেকেও দীপক দাশগুপ্ত বা নৃপেন চৌধুরীরা যে বয়সে কেন্দ্রীয় কমিটিতে এলেন, তাতে দলের ভবিষ্যতের জন্য কোনও ‘প্রকৃত উপকার’ হবে কি না সেই প্রশ্নও উঠছে। তবে দলের পলিটব্যুরোর এক সদস্যের মত, “আমাদের দলে উচ্চাকাঙ্খীদের বিশেষ জায়গা নেই। দায়িত্ব পাওয়ার জন্য সকলকেই অপেক্ষা করতে হয়।”
পশ্চিমবঙ্গের নেতৃত্বের একটি বড় অংশ তাজা রক্তকে গুরুত্ব দেওয়ারই পক্ষে। কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, “পলিটব্যুরোয় না-হয় পরিণত নেতাদেরই দরকার। কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটির ৮৭ বা ৮৯ জনের মধ্যে কয়েকটা তরুণ মুখ থাকবে না? সিদ্ধান্ত তো যৌথ ভাবেই নেওয়া হবে।” এ রাজ্যের নেতা, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দেব যেমন পার্টি কংগ্রেস থেকে ফেরার পথে কোঝিকোড় বিমানবন্দরে প্রকাশ্যেই ছাত্র নেতা ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়কে উৎসাহ দিয়ে বলেছেন, তাঁর ‘ভাল কাজ চালিয়ে’ যেতে।
তরুণ ব্রিগেড পা চালাচ্ছে। পলিটব্যুরোর পলিত-কেশ নেতারা ভাবছেন কি? |