রিজেন্ট পার্কের বসু পরিবারের ফ্ল্যাটে একসঙ্গে পাঁচ জনের মৃত্যুর কারণ নিয়ে এখনও অন্ধকারে পুলিশ। তবে ঘটনার দু’দিন বাদে বিভিন্ন সূত্র ও পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ খতিয়ে দেখে এর পিছনে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত কোনও খুনের তত্ত্ব ধোপে টিকছে না বলেই মনে করছেন লালবাজারের কর্তারা।
পুলিশের হাতে আসা ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট বলছে, ফুসফুসে কার্বন-মনোক্সাইড ঢুকে পাঁচ জনই দমবন্ধ হয়ে মারা গিয়েছেন। কার্বন-মনোক্সাইডের পরিমাণ এতটাই বেশি ছিল যে, কয়েক জনের ফুসফুস ফেটেও গিয়েছে বলে ময়না-তদন্তকারী চিকিৎসক জানিয়েছেন। মৃতদের পাকস্থলীতে বিষাক্ত কিছু মেলেনি। এর ফলেও, বিষাক্ত গ্যাসে মৃত্যুর সম্ভাবনাই জোরালো হচ্ছে।
তবে গৃহকর্তা সুপ্রতিম বসু এবং তাঁর বাবা সুদেশ বসুর দেহ অনেকটাই পুড়ে গিয়েছিল। তাঁদের মাথার চুলও পুড়ে যায়। কিন্তু সুপ্রতিমবাবুর বড় মেয়ে সারণী, ছোট মেয়ে সহেলি ও স্ত্রী সঙ্গীতার দেহ ততটা পোড়েনি।
কিন্তু ম্যুর অ্যাভিনিউয়ের ওই ফ্ল্যাটে হঠাৎ আগুন লাগল কী ভাবে?
তদন্তকারী অফিসারদের কাছে এর নিশ্চিত জবাব নেই। তবে কিছু সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করে পুলিশকর্তাদের কারও কারও মতে, ওই রাতে বাড়ির কারও সঙ্গে কথা কাটাকাটির জেরে উত্তেজনায় সুপ্রতিমবাবু হয়তো নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে আত্মহননের চেষ্টা করেন। ফ্ল্যাটের হলঘরে (যেখানে ডিভানে ঘুমোতেন বৃদ্ধ সুদেশবাবু ও দুই নাতনি) ঘটনাটি ঘটে। বন্ধ ঘরে এসি চালানো অবস্থায় সুপ্রতিমবাবু গায়ে আগুন দেওয়ায় সেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে ঘর কালো ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছিল বলে মনে করছেন তদন্তকারীদের একাংশ। এক গোয়েন্দা-কর্তার কথায়, “ঘরে এত দ্রুত আগুনটা ছড়িয়ে পড়ে যে, দরজার ছিটকিনি খুলে কেউ বেরোনোরও সুযোগ পাননি। হলঘর লাগোয়া বারান্দার দরজায় ছিটকিনির পাশে হাতের ছাপও মিলেছে। প্রাথমিক ভাবে বোঝা যাচ্ছে, ওই ছাপ সুদেশবাবুর হাতের।”
কিন্তু তা হলে গৃহকর্ত্রী সঙ্গীতাদেবীর মাথায় ভারী জিনিস দিয়ে আঘাতের যে চিহ্ন মিলেছে, তার কী ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছেন গোয়েন্দা-অফিসারেরা? পাশের ঘরের বিছানায় রক্তের দাগই বা কী ভাবে এল?
বসু পরিবারের আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলে পুলিশের ধারণা, মৃত্যুর আগে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বাগবিতণ্ডা হয়। দু’জনের মধ্যে ধস্তাধস্তিও হয়ে থাকতে পারে। সম্ভবত তখনই সঙ্গীতাদেবীকে আঘাত করা হয়েছিল। কোনওমতে তিনি শোয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে হলঘরে ঢোকেন। স্ত্রীর পিছন পিছন সেখানে যান সুপ্রতিমবাবুও। এর পরেই সম্ভবত গায়ে আগুন লাগান সুপ্রতিমবাবু।
ওই ফ্ল্যাটে মেলা রক্তের দাগ থেকেও নমুনা সংগ্রহ করেছে পুলিশ। তদন্তকারীদের মতে, ওই রক্ত কার, তা পরীক্ষায় বোঝা গেলেই এই মৃত্যু-রহস্যের কিনারার পথে আরও এক ধাপ এগোনো যাবে।
তবে, কী ভাবে মৃত্যু ঘটে, তা স্পষ্ট না-হলেও নানা কারণে সুপ্রতিমবাবুরা যে অশান্তিতে ছিলেন, সে বিষয়ে নিশ্চিত পুলিশ। পরিবারের মাথায় বিপুল দেনা থাকা ছাড়াও ইদানীং বড় মেয়ের সঙ্গে মা-বাবার কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। মেয়ের সঙ্গে সুপ্রতিমবাবূুর মাঝেমধ্যে কথা কাটাকাটি হত বলেও পুলিশ আত্মীয়দের থেকে জেনেছে।
ম্যুর অ্যাভিনিউয়ের পুরনো যে ফ্ল্যাট বিক্রি করে সুপ্রতিমবাবুরা এই ফ্ল্যাটে আসেন, সেখানে তদন্ত করেও বসু পরিবারের বেহাল আর্থিক অবস্থার আঁচ পায় পুলিশ। ওই ফ্ল্যাটটি ৩১ লক্ষ টাকায় শুদ্ধসত্ত্ব মুখোপাধ্যায়কে বিক্রি করবেন বলে ঠিক করেন সুপ্রতিমবাবু। কিন্তু ওই ফ্ল্যাটের জন্য ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিতে গিয়ে শুদ্ধসত্ত্ববাবু জানেন, ফ্ল্যাটটি বন্ধক আছে। সেই জন্য শেষ পর্যন্ত তা বিক্রি করে শুধু নগদ ১৩ লক্ষ টাকা পেয়েছিলেন সুপ্রতিমবাবু।
এ দিন দুপুরে ম্যুর অ্যাভিনিউয়ের ফ্ল্যাটের সামনেও ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার দুই অফিসারকে দেখা যায়। তাঁরা জানান, তাঁদের ব্যাঙ্কে সুপ্রতিমবাবুর অ্যাকাউন্ট ছিল। বাড়ির পাহারাদার সুনীল, এক পরিচারিকা এবং সুপ্রতিমবাবুদের পরিচারক অজয়কে দিনভর জেরা করে পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, ময়না-তদন্তের পরে পাঁচ জনের দেহই সুপ্রতিমবাবুর স্ত্রী সঙ্গীতাদেবীর আত্মীয়দের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সোমবার রাতে তাঁদের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। |