ছেলেরা দেখে না, মরতে চেয়েছিলেন দম্পতি
পেরেছিলেন রাজ-পূজা।
পারলেন না অনঙ্গ-বেলা।
সারা জীবন কেটে গিয়েছে সন্তানপালনে। তাদের সখ-আহ্লাদ মেটাতে মেটাতে খেয়ালই হয়নি, কখন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছেন।
যখন খেয়াল হল, তত দিনে ছেলেমেয়েদের আলাদা সংসার। তারা সফল, সুখী। প্রৌঢ় মা-বাবা এখন তাদের কাছে গলগ্রহ।
যেন ‘বাগবান’। অমিতাভ বচ্চন-হেমা মালিনী অভিনীত, বক্স অফিসে ঝড় তোলা সেই ছবি প্রৌঢ় দম্পতির ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। তাঁরা, রাজ ও পূজা মলহোত্র, সন্তানদের কৃতঘ্নতায় ব্যথিত হন। কিন্তু জীবনযুদ্ধে কখনও হেরে যান না।
সিনেমাসুলভ কোনও ‘সব পেয়েছি’র দেশে কিন্তু পৌঁছতে পারেননি দুর্গাপুরের বৃদ্ধ দম্পতি অনঙ্গ আর বেলা সরকার। সন্তানদের অবহেলা আর গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে তাই সিদ্ধান্ত নেন, বুড়োবুড়ি দু’জনে মিলে আত্মহত্যা করবেন। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ডুব দিয়েছিলেন গঙ্গায়। ঘাটের লোকজন তাঁদের অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করেন। দু’জনেই এখন কালনা হাসপাতালে ভর্তি।
কালনা মহকুমা হাসপাতালে বেলা সরকার ও অনঙ্গ সরকার। মঙ্গলবার। নিজস্ব চিত্র
কেন আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা? মঙ্গলবার কালনা হাসপাতালে মেল ওয়ার্ডে বসে জীবনের ইতিবৃত্ত শোনাচ্ছিলেন বছর পঁচাত্তরের অনঙ্গ। ফিমেল ওয়ার্ডে ভর্তি তাঁর স্ত্রী, ষাটোর্ধ্ব বেলা সরকার। পুলিশের কাছে খবর পেয়ে তাঁদের এক ছেলে অচিন্ত্য এ দিন হাসপাতালে যান। বাকিরা এখনও যাননি।
অনঙ্গবাবুদের বাড়ি দুর্গাপুরের প্রমোদনগর এলাকার কুরুলিয়াডাঙায়। যত দিন সক্ষম ছিলেন, বেনাচিতি-কালনা রুটে বাস চালাতেন অনঙ্গবাবু। মানুষ করেছেন পাঁচ ছেলে সুশান্ত, জয়ন্ত, সুভাষ, অচিন্ত্য ও অরুণকে। ছোট ছেলে অরুণ যখন সাড়ে তিন বছরের, অনঙ্গবাবুর প্রথম স্ত্রী মারা যান। বছর দেড়েক বাদে বেলাকে বিয়ে করেন তিনি। তাঁদের আর সন্তান হয়নি। এখন ছেলেরা প্রত্যেকেই প্রতিষ্ঠিত, ছোট-বড় ব্যবসা করেন। কুরুলিয়াডাঙার ভাড়াবাড়ি ছেড়ে একে একে বেরিয়ে গিয়ে আশপাশেই নিজেদের বাড়ি করে নিয়েছেন তাঁরা। সুশান্ত থাকেন অঙ্গদপুরে, জয়ন্ত গোপালমাঠে, অরুণের বাড়ি রঘুনাথপুরে। সুভাষ ও অচিন্ত্য কুরুলিয়াডাঙাতেই পাশাপাশি বাড়ি করেছেন।
কিন্তু কোনও ছেলের বাড়িতেই পাকাপাকি ঠাঁই হয়নি বুড়ো-বুড়ির। বছর দশেক ধরে তেমন কোনও কাজ করতেন না অনঙ্গবাবু। অচিন্ত্যর বাড়িতে ছোট একটি ঘরে থাকতেন তাঁরা। খেতেন সেজো ছেলে সুভাষের কাছে। এক দিন সেটাও গেল।
অনঙ্গবাবুর আক্ষেপ, “সম্প্রতি অচিন্ত্য ও তার স্ত্রী জানিয়ে দেয়, আমাদের থাকার ঘর ভেঙে নতুন করে গড়ে ভাড়া দেওয়া হবে।” বেলাদেবীর কথায়, “স্বামীর বাঁ পায়ে দগদগে ঘা। কানে ভাল শুনি না। এই অবস্থায় ছেলেদের গঞ্জনা আর সহ্য হচ্ছিল না। বাধ্য হয়েই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিই।” তাঁরা ঠিক করে ফেলেন, পুণ্যধাম বৃন্দাবনে গিয়েই ইহজীবনে ইতি টানবেন। সেজো ছেলে সুভাষের দাবি, “আমি কোনও গোলমালের কথা জানতাম না। অরুণের কাছে যাবেন জানিয়ে রবিবার মা-বাবা বেরিয়ে যান। তার পর থেকে তাঁদের আর খোঁজ পাইনি।”
সে দিন বিকেলে দুর্গাপুর থেকে ট্রেন ধরে বুড়ো-বুড়ি সোজা পৌঁছন হাওড়া স্টেশনে। ভিড়, ঠেলাঠেলি, ঘনঘন মাইকে ঘোষণা কিছুটা হকচকিয়েই যান দু’জনে। বৃন্দাবন যাবে কোন ট্রেন? একে ওকে জিজ্ঞেস করে যা-ও বা খোঁজ মিলল, ভাড়া শুনে চোখ কপালে। অত টাকা তো তাঁদের নেই! কী করেন, কোথায় যান? রাত কেটে গেল স্টেশনেই।
বাস চালানোর সুবাদে দুর্গাপুরের বাইরে কালনাই বেশি চেনা ছিল অনঙ্গবাবুর। অনেক পুরনো মন্দির আছে সেখানে। গঙ্গার তীরে বড় বড় ঘাট। না-ই বা যাওয়া হল বৃন্দাবন, কালনায় গিয়ে মরাটাই বা মন্দ কীসের ভাবছিলেন অনঙ্গবাবু। বৃদ্ধা স্ত্রীর হাত ধরে শেষমেশ চেপে বসেন কাটোয়া লোকালে। কালনা স্টেশন থেকে মহিষমর্দিনীতলা ঘাট বেশ দূরে। অনঙ্গবাবু পকেটে ছিল তখন শ’খানেক টাকা পড়ে। পঁচিশ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে সোজা ঘাটে চলে যান তাঁরা।
অনঙ্গবাবুর কথায়, “ঘাটে নামার আগে নিজে পাঁচটা ঘুমের বড়ি খাই। দশটা দিই স্ত্রীকে।” খানিক বাদে নেমে যান জলে।
ভাগ্য ভাল, মহিষমর্দিনীতলা ঘাটে সব সময়ই বেশ ভিড় থাকে। জলের কিনারে প্রায় চেতনাহীন পড়ে বুড়ো-বুড়ির দিকে নজর পড়ে কয়েক জনের। তাঁরাই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে তুলে হাসপাতালে পাঠান। পরে বৃদ্ধের চশমা রাখার খাপ থেকে পুলিশ কয়েকটি মোবাইল নম্বর পায়। অচিন্ত্য খবর পান। তিনি অবশ্য বাবা-মাকে ঘরছাড়া করার অভিযোগ স্বীকার করেননি। তাঁর দাবি, “আমি একাই মা-বাবার দেখভাল করতাম। অন্য দাদা-বৌদিরা খোঁজখবরও নেয় না। নিজের ভাল আয় না থাকায় কিছু সমস্যা হচ্ছিল। আমার স্ত্রীর সঙ্গে মা-বাবার কথা কাটাকাটি হয়ে থাকতে পারে। তবে আমার সঙ্গে কিছু হয়নি। আমি বাবা-মাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাই।” কিন্তু ছেলের কাছে আর ফিরে যেতে চান না ওই দম্পতি।
বেলাদেবীর আক্ষেপ, “নিজের সন্তান পাইনি। পাঁচ ছেলেকেই নিজের সন্তান মনে করে এসেছি। কখনও ওদের ছেড়ে কোথাও যাইনি। এই তার প্রতিদান!” অনঙ্গবাবু বলেন, “ছেলেদের কাছে ফিরব না। ওরা আলাদা ঘরভাড়া করে না দিলে দুর্গাপুরে আর ফিরব না। গাছতলাতেই থাকব।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.