সরকারি হাসপাতাল জানিয়েছিল, শয্যা নেই। তাই বমি বন্ধ করার ওষুধ ও ইঞ্জেকশন দিয়ে রোগিণীকে অন্যত্র রেফার করেছিল তারা। পাশাপাশি, পরীক্ষা করে চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, সমস্যাটা ডিহাইড্রেশন এবং রক্তাল্পতার। রোগিণীর হার্টের কোনও সমস্যা নেই।
৬৫ বছরের বৃদ্ধা মা শোভারানি বারিককে নিয়ে কোথায় যাবেন, সেই চিন্তায় নিমতার চিরঞ্জীব বারিক যখন কিছুটা বিভ্রান্ত, তখন হাসপাতালের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাম্বুল্যান্সচালক এগিয়ে এসে স্বঘোষিত পরামর্শদাতার ভূমিকা নেন। অভিযোগ, চিরঞ্জীববাবুকে তিনি বলেন, “সব সরকারি হাসপাতালেই শয্যার অভাব, তাই সকলেই ফিরিয়ে দেবে। স্থানীয় এক নার্সিংহোমে নিয়ে গেলে কম খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।” ওই চালকই তাঁর অ্যাম্বুল্যান্সে চিরঞ্জীববাবু ও শোভাদেবীকে নার্সিংহোমে নিয়ে যান। সেখানে ডিহাইড্রেশনের কোনও চিকিৎসা না করে তাঁর হার্টের চিকিৎসা শুরু হয় বলে অভিযোগ। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যু হয় ওই বৃদ্ধার।
পুলিশ ও স্বাস্থ্য দফতরে করা লিখিত অভিযোগে চিরঞ্জীববাবু জানিয়েছেন, নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়ার পরে ওই চালককে তাঁর ‘কমিশন’ বাবদ কিছু টাকা দেন নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ। তাঁর অভিযোগ, নার্সিংহোমে কর্তব্যরত চিকিৎসক হার্ট ফেলিওরের চিকিৎসার জন্য ছ’ঘণ্টার মধ্যে তিনটি ইঞ্জেকশন দেন। যাতে তাঁর মায়ের শরীরে খুব দ্রুতই জলীয় পদার্থ তলানিতে গিয়ে ঠেকে। বারবার জানতে চাওয়া সত্ত্বেও মায়ের শারীরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁকে কিছু জানানো হয়নি বলে অভিযোগ চিরঞ্জীববাবুর।
তাঁর প্রশ্ন, “সরকারি হাসপাতালে ‘অবজার্ভেশন ওয়ার্ড’ চালু হয়েছে বলে শুনেছি। তা হলে কেন সেখানেও কিছুক্ষণের জন্য মায়ের ঠাঁই হল না? কেন সরকারি হাসপাতালে বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স-চালকেরা নার্সিংহোমের হয়ে দালালি করবেন? সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা হার্টের সমস্যা নেই বলে জানানোর পরেও নার্সিংহোমে হার্টের চিকিৎসাই শুরু হল। কোন চিকিৎসক ঠিক রোগ নির্ণয় করছেন, সেটাই বা কে বলবে?”
হয় মহাকরণ, নয় স্বাস্থ্য ভবন। মায়ের মৃত্যুর বিচার চেয়ে এখন এই দুই জায়গাতেই হত্যে দিয়ে পড়ে থাকছেন চিরঞ্জীববাবু। এ রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে কী ভাবে গলদ থেকে গিয়েছে, তা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠিও দিয়েছেন তিনি। অভিযোগ জানিয়েছেন পুলিশেও। কয়েক মাস কেটে যাওয়ার পরেও কোনও তরফের জবাব না পেয়ে তথ্যের অধিকার সংক্রান্ত আইন প্রয়োগ করে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চান তিনি। তার জবাবে সম্প্রতি পুলিশ জানায়, প্রাথমিক ভাবে তারা চিকিৎসার গাফিলতির প্রমাণ পায়নি। তবে স্বাস্থ্য দফতরকে এ বিষয়ে অনুসন্ধান চালানোর অনুরোধ জানায় তারা।
স্বাস্থ্য দফতর থেকে কি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে? চিরঞ্জীববাবু জানান, না। কীসের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট নার্সিংহোম শোভাদেবীর হার্টের চিকিৎসা শুরু করল? নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ জানান, যেহেতু মৃতদেহের ময়না-তদন্ত হয়নি, তাই এ বিষয়ে তাঁরা কিছু বলতে বাধ্য নন।
স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “সরকারি হাসপাতালের ভিতরে বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্সের দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধ করতে সরকার বহু দিন ধরেই উদ্যোগী। বহু ক্ষেত্রে রোগীকে যে অ্যাম্বুল্যান্সে নিয়ে আসা হয়, বাড়ির লোকেরাই সেটি দাঁড় করিয়ে রাখেন। এ ক্ষেত্রে কী হয়েছিল, খোঁজ করছি। হাসপাতালের ভিতরে দালাল-চক্র আমরা ভাঙবই।”
এত দিন কেন তদন্ত শুরু হয়নি? সেই প্রশ্নের কোনও জবাব অবশ্য কারও কাছেই মেলেনি। |